ড. মুহাম্মদ ইউনুস—একজন নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, বিশ্বজুড়ে সুপরিচিত ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা বিপ্লবের পথপ্রদর্শক। তবে অর্থনৈতিক মডেল তৈরির বাইরেও তার আরেকটি পরিচয় রয়েছে—তিনি মানবাধিকারের প্রশ্নে সাহসিকতার সাথে কথা বলা একজন কণ্ঠস্বর। বিশেষ করে ফিলিস্তিন-রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার ধারাবাহিক অবস্থান, আজকের রাজনৈতিক ও ভন্ডামিতে ভরা বাস্তবতায় এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।
২০১৪ সালের ২৬ জুলাই, ইসরায়েল যখন গাজায় নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করছিল, যখন শত শত নিরীহ ফিলিস্তিনি নারী-শিশু শহীদ হচ্ছিল—তখন বিশ্বের অধিকাংশ প্রভাবশালী মানুষ নীরব ছিল। কিন্তু ড. ইউনুস ছিলেন ভিন্ন। তিনি একঝাঁক নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর সঙ্গে যৌথ বিবৃতিতে এই বর্বরতার তীব্র নিন্দা জানান। সেই বিবৃতিতে ‘বাস্তব ও স্থায়ী শান্তির’ জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে কার্যকর পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হয়।
এটি ছিল এমন এক সময়, যখন পশ্চিমা করপোরেশন ও মিডিয়াগুলো ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে গাজায় হামলাকে আত্মরক্ষা হিসেবে তুলে ধরছিল। সেই প্রেক্ষাপটে ইউনুসের অবস্থান ছিল অত্যন্ত কৌশলী, রাজনৈতিক এবং নৈতিক সাহসিকতায় ভরা। এমন অবস্থান গ্রহণ অনেক বড় বড় রাষ্ট্রপ্রধানও নিতে ভয় পান।
এর কয়েক বছর পর, ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পরিকল্পিত জাতিগত নিধনযজ্ঞ চালায়। আগুনে পুড়ে যায় গ্রাম, হত্যা করা হয় শিশুদের, ধর্ষণ করা হয় নারীদের, লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
এই মুহূর্তে, ড. ইউনুস আবারও মানবতার পক্ষে সাহসী ভূমিকা রাখেন। সকল কূটনৈতিক প্রটোকল ও আনুষ্ঠানিকতার বাইরে গিয়ে তিনি সরাসরি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে একটি আবেদন পেশ করেন—যেখানে তিনি রোহিঙ্গা সংকটে জরুরি হস্তক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
একজন ব্যক্তিগত নাগরিক হিসেবে জাতিসংঘের মতো মহাসংস্থার প্রতি এইরকম সরাসরি আবেদন নজিরবিহীন। এটি প্রমাণ করে, ইউনুস শুধু তাত্ত্বিক চিন্তাবিদ নন, বরং প্রয়োজনে তিনি কাঠামোগত বাধা অতিক্রম করে বাস্তব পদক্ষেপ নিতেও দ্বিধা করেন না।
ফেসবুকে মীর সালমান সামিল নামক এক ব্লগার ও ইসলামী অ্যাক্টিভিস্ট তার ফেসবুক পোস্টে ড. ইউনুসকে এভাবে মূল্যায়ন করেন,
“আমরা যারা ২০০৭ সাল থেকেই ফিলিস্তিনের পক্ষে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি—স্কুল জীবন থেকেই কোক/পেপসি বয়কটের ক্যাম্পেইনে লিফলেট বিলি করেছি, পণ্যের তালিকা প্রিন্ট করে বন্ধুদের দিয়েছি, পরে অনলাইনে ছড়িয়ে দিয়েছি—আমরা জানি কে আসলে এই আন্দোলনের পাশে ছিল, আর কে কেবল ট্রেন্ড দেখে হঠাৎ জেগে উঠেছে।”
তিনি আরো বলেন,
“আজকের দিনে, যখন অনেকে হঠাৎ করে ‘ধর্মীয় জাগরণ’ বা সোশ্যাল মিডিয়া হাইপ দেখে ফিলিস্তিন নিয়ে পোস্ট করে, তখন তারা হয়তো ইতিহাস বা ধারাবাহিকতা বোঝে না। এমন অনেকেই দেখা যায় যারা ইউনুসের মতো একজন পরীক্ষিত মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বের সমালোচনা করে, শুধু কারণ তিনি তাদের মতো করে ফেসবুক পোস্ট দেন না।”
তবে বাস্তবতা হলো, ড. ইউনুস তার নিজের আন্তর্জাতিক অবস্থান, খ্যাতি ও নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছেন—নিয়মিত, স্পষ্ট এবং সাহসিকতার সঙ্গে।
সম্প্রতি, ইউনুস পশ্চিমা করপোরেশনগুলোর দ্বিচারিতা ও যুদ্ধমুনাফার নীতিরও প্রকাশ্য সমালোচনা করে চলেছেন। এইসব করপোরেট শক্তি যেভাবে দখলদার রাষ্ট্রগুলোকে অর্থ ও রাজনৈতিক সমর্থন জোগায়, সেগুলোকে নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে চলেছেন তিনি। এমন কথা বলার সাহস আজকের দিনে খুব কম মানুষের রয়েছে—বিশেষ করে যাদের আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ থাকে।
ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে নিয়ে সমালোচনা তখনই আসে যখন ইতিহাস উপেক্ষা করে হঠাৎ আবেগে ভেসে যাওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি শুধু নোবেল বিজয়ী নন, বরং একজন অসাধারণ নৈতিক পথপ্রদর্শক। ফিলিস্তিন হোক বা রোহিঙ্গা—যখন অনেকেই চুপ থাকেন, তখন তিনি কথা বলেন। সাহসের সঙ্গে, যুক্তির সঙ্গে, আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রভাব সৃষ্টি করে।
ফিলিস্তিনের জন্য কাঁদতে হলে—আসল কণ্ঠগুলোকে চিনতে শিখতে হবে। আর ফিলিস্তিন-রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউনুস তাঁদের মধ্যে নিঃসন্দেহে একজন।