“নির্বাচনই কি একমাত্র সমাধান ”
বাংলাদেশের রাজনীতি আজও দ্বিধা ও সংঘাতে জর্জরিত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রায় প্রতিটি নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে-পরে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এমন প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গুলোর সংস্কার ছাড়া—নির্বাচন কি এই সংকটের একমাত্র সমাধান?
নির্বাচন গণতন্ত্রের প্রাণ। একটি গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন জনগণের মত প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য তখনই সফল হয়, যখন তা অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য হয়। বিগত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা বলছে, দেশের বড় একটি অংশ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি বা আস্থার সংকটে ভুগেছে।
২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, আর ২০১৮ সালে রাতের ভোট নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তা এখনো রাজনৈতিক মঞ্চে প্রবল। বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, রাষ্ট্রযন্ত্র নির্বাচনে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখেনি। ফলে প্রশ্ন থেকে যায়—এই পরিস্থিতিতে শুধু নির্বাচন আয়োজন করলেই কি সংকটের সমাধান হবে?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের তোপের মুখে ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং দেশ থেকে পালিয়ে যায়। ৮ই আগস্ট শপথ গ্রহণের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয় এবং দেশের দায়িত্বভার গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপরে জনমনে তৈরি হয় নতুন আকাঙ্ক্ষা। ক্ষমতার ভারসাম্য, সুনিয়ন্ত্রিত আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতিরোধ, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ,স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বলিষ্ঠ প্রতিরক্ষা, স্বাধীনভাবে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকারসহ সব গণতান্ত্রিক অধিকার পূরণ করবে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এমনটাই আশা করে দেশের মানুষ।
দেশের মানুষের এই প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যে সরকার ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনসহ মোট ১১টি কমিশন গঠন করে। নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনকে প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়। নানা কারণে সংস্কার কমিশন গুলোর প্রতিবেদন জমা দিতে বিলম্ব হয়। তবে একে একে প্রতিটি সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন ইতিমধ্যে জমা দিছে।
তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ এবং সংস্কার কার্যক্রমে মত পার্থক্য দেখা যাচ্ছে কিছু রাজনৈতিক দলের। সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং চলমান প্রক্রিয়া এমনটাই মনে করছে কিছু কিছু রাজনৈতিক দল। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল মনে করে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিগত সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানগুলো একদমই ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠানের সংস্কার ছাড়া নির্বাচন দিলে সে নির্বাচন বিগত সময়ের মত প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নির্বাচনের জন্য দু’টি সম্ভাব্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে এবং নির্ধারিত তারিখ পরিবর্তন করা হবে না। তবে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের আগে সীমিতসংখ্যক সংস্কার চাইলে নির্বাচন ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত হবে। আর যদি বৃহত্তর পরিসরে সংস্কার চায় তাহলে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) এর একটি জরিপে অংশ নেওয়া সরাসরি ৪১ দশমিক ৪০ শতাংশ ও অনলাইনে অংশ নেওয়া ৫০ দশমিক ৯০ শতাংশ তরুণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ অন্তত ১-৩ বছরের মতো হওয়া উচিত বল মনে করে। জরিপে তরুণদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা, জলবায়ু পরিবর্তন, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র ও সুশাসন, তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গি এবং দেশান্তর বিষয়ে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। এতে অংশ নিয়ে বিগত সরকারের আমলের চেয়ে বর্তমানে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে তরুণরা নিজেদের মতামত প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে এমনটাই জানান । বর্তমানে তরুণদের কাছে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা এই তথ্য থেকে বোঝা যায়।
তবে রাজনৈতিক দলের তড়িঘড়ি এবং দেশের ভিতর কৃত্রিম অস্থিরতা প্রেক্ষাপটে দেওয়া জাতীয় নির্বাচন আদৌও ফলপ্রসূ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে দেশের জনগণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট কেবল ভোটের বাক্সে সীমাবদ্ধ নয়। সমস্যার মূল শিকড় রাজনীতির সংস্কৃতিতে। দলীয় সহনশীলতার অভাব, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতার অভাব এবং গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ—সব মিলিয়ে একটি অবিশ্বাসের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে পূর্বে থেকে।
এই প্রেক্ষাপটে প্রয়োজন একটি সার্বিক সমাধান। যার মধ্যে থাকবে নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার, জাতীয় ঐক্য, রাজনৈতিক সংলাপ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালীকরণ এবং জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, কিন্তু সেটি যেন গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি হয়। আর এজন্য প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিপূর্ণ সংস্কার যেন দেশের মানুষ সুষ্ঠুভাবে তার ভোট অধিকার প্রয়োগ করতে পারে।
তাই, নির্বাচন একমাত্র সমাধান নয়—এটি বৃহত্তর গণতান্ত্রিক কাঠামোর একটি অংশ মাত্র।
শিক্ষার্থী গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ,রংপুর।