ভাবতে পারেন? একটি ছোট্ট ক্যাপসুল গিলে ফেললেই তা আপনার পেট, নাড়ি ভুড়িরস্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ করবে, আপনার আবেগ ট্র্যাক করবে, এমনকি স্নায়বিক রোগের পূর্বাভাসও দিয়ে দেবে। এ সবই বিনা অপারেশনের মাধ্যমে শুধু ছোট ক্যাপসুল গিলে। শুনতে কল্পবিজ্ঞানের মতো মনে হলেও বাংলাদেশী বিজ্ঞানী ড. ইয়াসির খান মনে করেন, এটাই ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবা। তিনি বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া (USC)-তে ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করছেন।
চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা ড. খান ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস, ডালাস থেকে পড়াশোনা করেছেন, এরপর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন এবং স্ট্যানফোর্ডে পোস্টডক করেন। বর্তমানে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-সক্ষম মেডিকেল ডিভাইস নিয়ে গবেষণা করছেন। তার সাম্প্রতিক উদ্ভাবন হলো একটি স্মার্ট পিল, যা অন্ত্র ও মস্তিষ্কের সংযোগ বোঝার পদ্ধতিতে বিপ্লব আনতে পারে।
ইয়াসির খান এর ক্যাপসুল
এই ওষুধটি বা ক্যাপসুলটি FDA অনুমোদিত সর্বোচ্চ আকারের চেয়েও ছোট এবং এটি এমন সেন্সরযুক্ত, যা গ্যাস্ট্রাইটিসের লক্ষণ থেকে শুরু করে আবেগ ও নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের সাথে সম্পর্কিত নিউরোকেমিক্যাল পর্যন্ত ট্র্যাক করতে পারে।
ড. খান ব্যাখ্যা করেন, “অন্ত্রকে প্রায়শই ‘দ্বিতীয় মস্তিষ্ক’ বলা হয়, কারণ এতে প্রায় ১০ কোটি নিউরন রয়েছে। যদিও এটি মস্তিষ্কের ৮৫ বিলিয়ন নিউরনের তুলনায় নগণ্য, অন্ত্র আমাদের আবেগ ও সামগ্রিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”
এই স্মার্ট পিলটি একটি পেন্সিলের সীসা বা কয়েকটি চালের দানার মতো আকারের হয়। এটি গিলে ফেলা হলে এটি স্বাভাবিকভাবে হজমনালীতে চলাচল করে এবং গ্যাস, রাসায়নিক ও নিউরাল কার্যকলাপ পরিমাপ করে। পিলটি শরীরের ভেতর দিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে। এটি সেন্সর ব্যবহার করে বিভিন্ন গ্যাস্ট্রিক চিহ্ন ও নিউরোকেমিক্যাল পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এছাড়াও, পেটের ওপর একটি পরিধানযোগ্য কয়েল পরা হয়, যা চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে পিলের অবস্থান রিয়েল-টাইমে ট্র্যাক করতে সহায়তা করে।
এই প্রযুক্তি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলেও, পরীক্ষার ফলাফল আশাব্যঞ্জক। ড. খানের দল সফলভাবে পরীক্ষাগারে পিলটি পরীক্ষা করেছে এবং এখন প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছে। “আমরা বর্তমানে ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা চালাচ্ছি, যেখানে মস্তিষ্ক ও অন্ত্রের কার্যকলাপ পরিমাপ করছি। সবকিছু ঠিক থাকলে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষা শুরু করতে পারব,” বলেন তিনি।
এই পিলের ব্যবহারের পরিধি অনেক বড়। এটি গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার নির্ণয়, মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ এবং নির্দিষ্ট ওষুধ সরাসরি অন্ত্রে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয়, ড. খান প্রযুক্তিটি সবার জন্য সহজলভ্য করতে চান। একটি সাধারণ সংস্করণ মাত্র ১০ ডলারে তৈরি করা যেতে পারে।
ড. খান উন্নয়নশীল দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য এই প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে চান। “আমরা পিলের বিভিন্ন সংস্করণ তৈরি করছি,” তিনি জানান। “গ্যাস্ট্রাইটিস পর্যবেক্ষণের জন্য একটি সাধারণ সংস্করণের দাম কয়েক হাজার টাকা হতে পারে, আর ক্লিনিকাল ব্যবহারের জন্য উন্নত সংস্করণ বেশি দামের হবে।”
তার কাজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে। তিনি সম্প্রতি Packard Fellowship পেয়েছেন, যা উদ্ভাবনী গবেষণাকে স্বীকৃতি দেয়। তিনি বলেন, “এটি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্মান। এই পুরস্কার শুধুমাত্র সেই গবেষণাকে দেয়া হয়, যা পুরো ক্ষেত্রকে বদলে দিতে পারে।” এছাড়াও এ বছর পেয়েছেন 2025 Air Force Young Investigator Award
আরও পড়ুনঃ
কেন আমি আমার বাচ্চাকে ‘গ্যাজেট’ দেবো না, স্বাধীনতা দেবো না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) কী? ব্যবহার, সুবিধা, ঝুঁকি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
স্মার্ট পিল ছাড়াও ড. খানের ল্যাবে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা চলছে। তার দল এমন পরিধানযোগ্য ডিভাইস তৈরি করছে, যা মানুষের ঘামের মধ্যে থাকা কর্টিসল মাত্রা পরিমাপ করে মানসিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। এটি ব্যান্ড-এইডের মতো দেখতে হবে এবং বিষণ্নতা ও বাইপোলার ডিসঅর্ডারের মতো মানসিক রোগের ব্যবস্থাপনায় সহায়ক হবে।
তিনি বলেন, “আমরা নতুন ধরনের প্রযুক্তি তৈরি করতে চাই, যা মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।” এই প্রকল্পটি বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথ (NIH)-এর সাথে যৌথভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
একটি অন্য প্রকল্পে, ড. খান এমন ব্রেইন ইমপ্লান্ট তৈরি করছেন, যা নিউরোকেমিক্যাল পর্যবেক্ষণ করে মৃগী রোগের মতো সমস্যার গভীরে যাওয়ার সুযোগ দেবে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, “সাধারণত ব্রেইন ইমপ্লান্ট শুধু নিউরাল কার্যকলাপ পরিমাপ করে, কিন্তু আমরা সেই রাসায়নিক উপাদানগুলোর ওপর নজর দিচ্ছি, যা মস্তিষ্কের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে।”
ড. খান ২০২২ সালে ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ায় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তার শিক্ষাজীবনের যাত্রা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দেওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। তিনি বলেন, “আমি ২০০৮ সালে বাংলাদেশ ছেড়েছি, কিন্তু আমি চাই, আমার উদ্ভাবন একদিন বাংলাদেশের মানুষের জন্য উপকারী হবে, যেখানে সাশ্রয়ী মূল্যের স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জরুরি।”
তার গবেষণাগারে বর্তমানে ২৪ জন গবেষক কাজ করছেন, যার মধ্যে তিনজন বাংলাদেশি পিএইচডি শিক্ষার্থী রয়েছেন। বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মেডিকেল প্রযুক্তিতে নতুন মাত্রা যোগ করতে চাইছেন। যদিও এই প্রযুক্তিকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনতে সময় লাগবে, তবে এর সম্ভাব্য প্রভাব বিশাল।
তিনি আশাবাদী, “আগামী পাঁচ বছরে, আপনি ফার্মেসিতে গিয়ে একটি স্মার্ট পিল কিনতে পারবেন এবং হাসপাতালের দরজায় না গিয়েই নিজের স্বাস্থ্য বিশ্লেষণ করতে পারবেন। এটাই ভবিষ্যৎ, যার জন্য আমরা কাজ করছি।”
এখন গোটা বিশ্ব অপেক্ষা করছে, কবে ড. ইয়াসির খান ও তার দল বিজ্ঞানের এই চমকপ্রদ উদ্ভাবনকে বাস্তবে রূপ দেবে।