সাজেক ভ্যালি (sajek valley ) এমন একটি নাম, যা শুনলেই কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
চারদিকে সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মেঘের আনাগোনা আর পাহাড়ি সংস্কৃতির অপূর্ব এক মেলবন্ধন।
এই সাজেক যেন প্রকৃতির আঁকা এক জীবন্ত চিত্রকর্ম। বর্ষা হোক বা শীত, সকাল হোক বা সন্ধ্যা—সাজেক ভ্যালি তার রূপে মুগ্ধ করে সবাইকে।
এখানে সময় যেন থমকে যায়, আর হৃদয় জেগে ওঠে প্রকৃতির বিশুদ্ধ ছোঁয়ায়।
সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি পাহাড়ি এলাকা, যা রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার অংশ।
যদিও এটি রাঙ্গামাটির অন্তর্ভুক্ত, ভৌগোলিকভাবে এটি খাগড়াছড়ি জেলার দিঘীনালা থেকে সহজে যাতায়াতযোগ্য হওয়ায় অধিকাংশ ভ্রমণকারী খাগড়াছড়িকেই বেছে নেন প্রবেশদ্বার হিসেবে।
সাজেক অবস্থিত মূলত লুসাই পাহাড়ের কোলে, যার বিস্তৃতি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত।
অনেকেই বিভ্রান্ত হন সাজেক রাঙ্গামাটি না খাগড়াছড়ি?
বাস্তবতা হলো, প্রশাসনিকভাবে এটি রাঙ্গামাটিতে, তবে যাতায়াত ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও পর্যটন সুবিধার কারণে অধিকাংশ পর্যটক খাগড়াছড়ি থেকেই যাত্রা শুরু করেন।
এটি রুইলুই ও কংলাক নামক দুইটি পাহাড়ি পাড়ার সমন্বয়ে গঠিত। যেখানে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠী বেশ শান্তিতে মিলেমিশে বসবাস করে।
আরও পড়ুনঃ
গাজার পক্ষে হলিউড তারকাদের একাট্টা প্রতিবাদ
টিপু সুলতান: ট্রেনে ট্রেনে ইংরেজি বই ফেরি করা সংগ্রামী এক প্রবীণ
খাগড়াছড়ি শহর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার।
তবে এই ৭০ কিলোমিটার যাত্রা যেন একরাশ রোমাঞ্চ আর বিস্ময়ের ভাণ্ডার।
পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা, চা-বাগানের পাশে ছুটে চলা চান্দের গাড়ি, আর পাহাড়ের ঢালে ঢালে গড়িয়ে পড়া মেঘের দল সব মিলিয়ে এই ভ্রমণ নিজেই এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।
ঢাকা থেকে সাজেক যেতে হলে প্রথমে বাসে করে খাগড়াছড়ি পৌঁছাতে হবে, যা প্রায় ৩১৬ কিলোমিটার দূরে।
এরপর খাগড়াছড়ি থেকে চান্দের গাড়িতে করে সাজেক। পুরো যাত্রায় সময় লাগে গড়ে ১০–১২ ঘণ্টা।
ঢাকা থেকে নিশা বাস, সেন্টমার্টিন পরিবহন, শ্যামলী কিংবা হানিফে করে খাগড়াছড়ি যাওয়া যায়।
কক্সবাজার থেকে সরাসরি সাজেকে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলেও, কক্সবাজার থেকে রাঙামাটি বা খাগড়াছড়ি হয়ে সাজেকে যাওয়া সম্ভব।
এই রুটটি দীর্ঘ হলেও যারা পাহাড় ও সমুদ্র একসাথে উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য চমৎকার।
চান্দের গাড়ি কি এবং কেন চান্দের গাড়ি বললেই সাজেকের কথা মনে আসে?
এটি আসলে একটি খোলা ট্রাক টাইপ যানবাহন, যা বিশেষভাবে সাজেক ও পার্বত্য অঞ্চলগুলোর উঁচু-নিচু রাস্তার উপযোগী করে তৈরি।
এটি যেন সাজেকের একটি ঐতিহ্য। চলন্ত এই গাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের রাস্তায় এগিয়ে যাওয়ার অনুভূতি এক কথায় অসাধারণ।
চান্দের গাড়ির ভাড়া সাধারণত ৮,০০০ থেকে ১২,০০০ টাকার মধ্যে, নির্ভর করে গাড়ির ধরন ও সিজনের উপর।
গাড়ি শেয়ার করে ভ্রমণ করলে খরচ কমে যায়। খাগড়াছড়ি শহরে পৌঁছেই স্থানীয় পর্যটন অফিস বা হোটেলের সহায়তায় আগেভাগে বুকিং করাই ভালো।
সাজেকে যাওয়ার সময় পর্যাপ্ত পানি, হালকা খাবার এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সঙ্গে রাখা উচিত।
বিদ্যুৎ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক সবসময় সচল নাও থাকতে পারে, তাই প্রস্তুত থাকা জরুরি।
সাজেকের হেলিপ্যাড এলাকাটি সবচেয়ে জনপ্রিয় ভিউ পয়েন্ট।
এখানে দাঁড়িয়ে মেঘ, পাহাড়, সূর্য আর নীল আকাশের একত্র মিলন চোখকে যেমন তৃপ্ত করে, তেমনি মনকেও করে শান্ত।
কংলাক পাহাড় সাজেকের সর্বোচ্চ চূড়া। এখান থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত দেখা যায়।
ভোরে কুয়াশা মাখানো পাহাড় আর নীচে বিস্তৃত বনভূমি এক অনুপম দৃশ্যের সৃষ্টি করে।
এই আদিবাসী পাড়া দুটি সাজেকের প্রাণ। এখানকার মানুষ, তাদের জীবনধারা, সংস্কৃতি ও হাসিমাখা মুখ আপনাকে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা দেবে।
এই গ্রামগুলোতে যেন পাহাড়-মেঘ-মাটি-মানুষ একসঙ্গে মিশেছে, একদম ছবির মতো।
প্রতি সকালে মনে হয় আপনি মেঘের রাজ্যে রয়েছেন। চারপাশে সাদা মেঘ, মাঝে মাঝে পাহাড়ের চূড়ায় বসে সূর্যের উঁকি , এ যেন এক মোহময় অভিজ্ঞতা।
সাজেকের গ্রামগুলোতে ঘরগুলো প্রধানত বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তৈরি। চারদিকে সবুজে ঘেরা পরিবেশে দাঁড়িয়ে আপনি পাবেন প্রকৃতির গভীর নীরবতা, যা শহুরে জীবনে অসম্ভব।
বর্ষায় সাজেক যেন মেঘ-ভেজা প্রেমকাহিনি, শীতে সূর্য আর কুয়াশার খেলা, আর বসন্তে ফুল আর পাখির মেলা—প্রতিটি ঋতুতে সাজেক নতুন করে ধরা দেয়।
সাজেকের সবচেয়ে জনপ্রিয় রিসোর্টগুলোর মধ্যে রয়েছে মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট, রুম্ময় রিসোর্ট, এবং জুমঘর ইকো রিসোর্ট। এই রিসোর্টগুলো থেকে ভিউ অসাধারণ।
যারা স্বল্প বাজেটে ভ্রমণ করতে চান, তাদের জন্য রয়েছে হোম-স্টে ও কমিউনিটি লজের ব্যবস্থা। এতে স্থানীয় সংস্কৃতিও উপভোগ করা যায়।
সাজেক ভ্যালিতে রিসোর্টের ভাড়া ২০২৫ সালে সাধারণত ২,৫০০ থেকে ৮,০০০ টাকার মধ্যে। সিজন ও ভিউ অনুযায়ী এই রেট ওঠানামা করে।
ঢাকা-খাগড়াছড়ি বাস ভাড়া ৮০০–১২০০ টাকা, চান্দের গাড়ি শেয়ার করলে জনপ্রতি ৮০০–১২০০ টাকা। হোটেল/রিসোর্টের খরচ, খাওয়া-দাওয়া মিলিয়ে জনপ্রতি খরচ গড়ে ৫–৭ হাজার টাকার মধ্যে।
বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ ট্রিপে গেলে খরচ ভাগ হয়। শেয়ার করা যানবাহন, হোম-স্টে আর স্থানীয় খাবার খাওয়াও খরচ কমানোর একটি উৎকৃষ্ট উপায়।
অনেক জায়গায় ক্যামেরা ফি, গাইড ফি, প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ওষুধপত্র এসব আলাদাভাবে লাগতে পারে।
সাজেক ভ্যালির মনোমুগ্ধকর ছবি – হৃদয়ে গেঁথে থাকবে
ভোরে কুয়াশায় মোড়ানো পাহাড়, সন্ধ্যায় লাল সূর্যের শেষ আলো, আর রাতে মেঘে ঢাকা আকাশ—সবই ফ্রেমবন্দি করার মতো।
সকাল ৬টা থেকে ৮টা দারুন সব ছবি তোলার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। হেলিপ্যাড, কংলাক পাড়া, রিসোর্টের ছাদ—এই স্থানগুলো ছবি তোলার জন্য আদর্শ।
গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্ক প্রায় সর্বত্রই ভালো কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় রবি ও টেলিটক নেটওয়ার্ক সবচেয়ে ভালো কাজ করে। তবে অনেক সময় সিগন্যাল দুর্বল থাকতে পারে।
সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ সাজেক ভ্রমণের সেরা সময়। তখন আকাশ পরিষ্কার থাকে এবং ভিউ অসাধারণ হয়।
স্থানীয় আদিবাসীদের জীবনধারার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা উচিত। অতিরিক্ত শব্দ, আবর্জনা ফেলা কিংবা ড্রোন উড়ানো এড়িয়ে চলা শ্রেয়।
সাজেক এমন এক জায়গা, যা চোখে দেখা শেষ হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু হৃদয়ে রয়ে যায় অনেক দিন। যারা একবার যান, তারা আবার যেতে চান। সেই নীরব পাহাড়, মেঘের ছোঁয়া আর পাহাড়ি মানুষের হাসিমাখা মুখ যেন বারবার হাতছানি দেয়।
ভবিষ্যৎ ভ্রমণকারীদের জন্য পরামর্শ হলো প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীল হোন, স্থানীয়দের সম্মান করুন, এবং সাজেকের সৌন্দর্য নিজের মতো করে অনুভব করুন। কারণ, সাজেক কেবল একটি গন্তব্য নয়, এটি প্রকৃতির সঙ্গে গভীর এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে তোলার উপযুক্ত স্থান।
আমাদের পথ চলায় সঙ্গী হন আপনিও: