উত্তরায় জেট বিমান বিধ্বস্তে নিহত-আহত বহু শিক্ষার্থী, দগ্ধদের চিকিৎসায় নতুন ভরসা ‘স্কিন ব্যাংক’
রাজধানীর উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের একাডেমিক ভবনে বিধ্বস্ত হয়েছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে বহু শিক্ষার্থী। অধিকাংশই স্কুলের তৃতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী, যাদের বয়স ১২ বছরের কম। মৃত্যু হয়েছে বিমানের পাইলট এবং স্কুলের এক শিক্ষিকারও।
ঘটনাটি ঘটে গতকাল (রোববার) দুপুর দেড়টার দিকে, যখন দোতলা ভবনে স্কুল শাখার ক্লাস চলছিল। বিকট শব্দে পুরো ভবন কেঁপে ওঠে। ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে বহু শিক্ষার্থী।
আজ সকালে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সাইদুর রহমান জানান, নিহতের সংখ্যা ২২ জন। তাদের মধ্যে ২০টি মরদেহ ইতোমধ্যে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশেরই মৃত্যু হয়েছে দগ্ধ হয়ে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।
এই পরিস্থিতিতে গুরুতর দগ্ধদের চিকিৎসায় নতুন ভরসা হয়ে উঠছে সদ্য চালু হওয়া ‘স্কিন ব্যাংক’। গত ৯ জানুয়ারি রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারিতে দেশের প্রথম স্কিন ব্যাংক চালু করা হয়। কারিগরি সহায়তা দিয়েছে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল। প্রশিক্ষিত ৮ জন চিকিৎসক ও নার্স এই ব্যাংক পরিচালনা করছেন।
স্কিন ব্যাংক কীভাবে কাজ করে?
স্কিন ব্যাংকের সমন্বয়ক ডা. মাহবুব হাসান জানান, আপাতত ওবেসিটি সার্জারি বা অ্যাবডোমিনোপ্লাস্টির সময় কাটা অতিরিক্ত ত্বকই স্কিন ব্যাংকে রাখা হচ্ছে। প্লাস্টিক সার্জনরা দাতার শরীর থেকে ত্বক সংগ্রহ করে বিশেষায়িত যন্ত্রে প্রসেসিং করেন। এরপর অ্যান্টিবায়োটিক সল্যুশনে ডুবিয়ে, জীবাণুমুক্ত করে বিশেষ ফ্রিজে -৯০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। এই ত্বক ৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহারযোগ্য থাকে।
গতকাল পর্যন্ত ব্যাংকে ৭ জন ডোনারের শরীর থেকে ৪,৫০০ বর্গসেন্টিমিটার ত্বক সংগ্রহ হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিনজন দগ্ধ রোগীর শরীরে সফলভাবে ত্বক প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক ডা. শাওন বিন রহমান বলেন, “শরীরের ৩৫-৫০ শতাংশ পোড়া রোগীদের ক্ষেত্রে ত্বক প্রতিস্থাপন জীবন বাঁচানোর একমাত্র উপায়। স্কিন গ্রাফট দিলে সংক্রমণ কমে, ফ্লুইড লস বন্ধ হয়, নতুন ত্বক দ্রুত গজায়। এতে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনা অনেক বাড়ে।”
মরণোত্তর ত্বক দান এখনও চালু হয়নি:
বর্তমানে মরণোত্তর ত্বক সংগ্রহের সুযোগ না থাকলেও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মৃতদেহ থেকে ৬-১০ ঘণ্টার মধ্যে পিঠ বা উরু থেকে ত্বক সংগ্রহ করা যায়।
নতুন চ্যালেঞ্জ:
বার্ন ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. মারুফুল ইসলাম বলেন, “এত বড় দুর্ঘটনার পর স্কিন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট হয়েছে। ত্বক দানে আইনগত বাধা নেই। তবে ব্যাপক সচেতনতা ও দাতার অংশগ্রহণ ছাড়া ব্যাংক সমৃদ্ধ করা কঠিন।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বার্ন ইনস্টিটিউটে বার্ষিক প্রায় ১৩ হাজার রোগী ভর্তি হন। এদের অনেকে স্কিন গ্রাফটিং সুবিধার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তাই, স্কিন ব্যাংকের সক্ষমতা বাড়ানো এবং মরণোত্তর ত্বক দান আইন বাস্তবায়ন জরুরি।
সরকার ইতোমধ্যে দুর্ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আহতদের উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি স্কিন গ্রাফটিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে বার্ন ইনস্টিটিউট।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বার্ন চিকিৎসায় স্কিন ব্যাংক এক নতুন যুগের সূচনা। তবে এর সুফল পেতে হলে এখনই ত্বক দান বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।