বুয়েটে মুফতি তারিক মাসউদ (হাফিজাহুল্লাহ) - ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া মানুষ পূর্ণতা পায় না - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:
শিরোনামঃ
বুটেক্স স্পিনার্স ক্লাবের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল ‘স্পিনার্স ফিয়েস্তা ৩.০’ বছরজুড়ে ডেঙ্গুর হুমকি: টিকা আবিষ্কার হলেও কেন এখনো বাংলাদেশে ব্যবহার হচ্ছে না? ১৩ নভেম্বর ঘিরে নিরাপত্তা জোরদার, সারাদেশে সতর্ক অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে রাবি জিয়া পরিষদের সভাপতির পদ হারালেন অধ্যাপক এনামুল  দেশেই হবে বিশ্বমানের বন্ধ্যত্ব চিকিৎসা, তুরস্কের বিনিয়োগে নতুন হাসপাতাল টিএফডির শিরোপা জয়, তবু বুটেক্সে অশান্তি; খেলাকেন্দ্রিক সংঘাতে তদন্ত শুরু ট্রাম্পের হুমকিতে মামদানির জবাব: উন্নয়ন তহবিল বন্ধ হলে আদালতে যাব শেকৃবিতে কর্মকর্তা–কর্মচারীকে মারধরের ঘটনায় বহিষ্কৃত ও ড্রপআউট ছাত্রদলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ইবিতে সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় ৩ শিক্ষার্থী বহিষ্কার বাঁচতে চায় ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত কুবি শিক্ষার্থী প্রভা

বুয়েটে মুফতি তারিক মাসউদ (হাফিজাহুল্লাহ) – ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া মানুষ পূর্ণতা পায় না

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই, ২০২৫
  • ২১০ বার দেখা হয়েছে

বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দাওয়াতি সফরে এসেছেন পাকিস্তানের জনপ্রিয় ইসলামি চিন্তাবিদ মুফতি তারিক মাসউদ হাফিজাহুল্লাহ। ৯ দিনের এই সফরের সূচনা হলো আজ ২৪ জুলাই ২০২৫, বৃহস্পতিবার, রাজধানীর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এ তাঁর প্রথম বয়ানের মাধ্যমে। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে আয়োজিত এই মাহফিলে হাজারো শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ উপস্থিত হন। শিক্ষার্থীদের মাঝে ছিল ৩০০-এর বেশি নারী শিক্ষার্থী, যাদের জন্য পর্দাসহ পূর্ণাঙ্গ আয়োজন করা হয়।

তার সহজাত হাস্যরসাত্মক অথচ গভীর বক্তব্যে মিলনায়তন পরিণত হয় এক ভাবগম্ভীর পরিবেশে, যেখানে তরুণদের হৃদয়ে স্থান করে নেয় ঈমান, আত্মবিশ্বাস ও যুক্তিনির্ভর ধর্মচর্চার কথা। তার প্রথম বয়ানে শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে গভীরভাবে।

একটি নিঃশব্দ, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও শিক্ষিত শ্রোতামণ্ডলীর সামনে তিনি তার বয়ান শুরু করেন হালকা হাস্যরসের মধ্য দিয়ে। বলেন, “এটাই আমার বাংলাদেশে প্রথম সফর।” এরপরই তিনি আন্তরিকভাবে প্রশ্ন করেন—“আপনাদের মধ্যে ক’জন উর্দু বা হিন্দি বোঝেন?” মিলনায়তনে উপস্থিত প্রায় সবাই হাত তুললে তিনি খুশি হয়ে বলেন, “তাহলে আজ আমি নিজের ভাষায় আপনাদের হৃদয়ে কথা বলতে পারব।” তিনি বলেন, ইন্ডিয়ান সিনেমা, তাবলিগ কার্যক্রম, মাদ্রাসা ইত্যাদির মাধ্যমেই এই ভাষাগত সংযোগ গড়ে উঠেছে, যা এই জমিনে দাওয়াতের পথ আরও সহজ করে দিয়েছে।

এরপর তিনি বলেন, “আজ আমি শুধু কারও সামনে নয়, আমি দাঁড়িয়ে আছি বাংলাদেশের সবচেয়ে নামী প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সামনে।” তিনি জানান, ৩০০-এর বেশি নারী শিক্ষার্থীর পর্দাসহ উপস্থিতি তাকে অভিভূত করেছে। এমন পরিপাটি ও ব্যবস্থাপনার মধ্যে ইসলামি মাহফিল—এ যেন তাঁর কাছে একটি অনন্য অভিজ্ঞতা।

বক্তব্যের শুরুতেই তিনি স্পষ্টভাবে আলাদা করেছেন ধর্মীয় অনুপ্রেরণা বনাম দুনিয়াবি মোটিভেশনাল কথা। “একজন বিজ্ঞানী বা মোটিভেশনাল বক্তা কিছু কথা বললে হয়তো আপনি কয়েক ঘণ্টা অনুপ্রাণিত থাকেন। কিন্তু আল্লাহ যদি একটি নির্দেশ দেন, সেই অনুপ্রেরণা চলে যায় অন্তরের গভীরে, জীবনকে বদলে দেয়।”

এই প্রসঙ্গে তিনি ইতিহাসের বড় উদাহরণ টানেন—“যখন রাসুল (সা.) ঘোষণা করেন, মদ হারাম, তখন মদ ঢেলে দেওয়া হয় রাস্তায়, অন্ধকার গলিতে। আজ ১৪০০ বছর পরও এই উম্মতের অধিকাংশ মদ থেকে দূরে থাকে। অথচ পশ্চিমা সভ্যতা লাখো ডলার ব্যয় করেও মদ্যপানের অভিশাপ রোধ করতে পারে না।”

তিনি বলেন, “যে জাতি রোজার মাসে দিনের ১৪ ঘণ্টা কিছু খায় না, পান করে না, কেবল একটিমাত্র বিশ্বাসে—আল্লাহ দেখছেন, তিনিই নির্দেশ দিয়েছেন—তাদের মধ্যে যে শক্তি আছে, তা কোনও রাষ্ট্রীয় আইনেও নেই।”

জাতিগত বিভাজনের ঊর্ধ্বে মানবতা ও ইসলাম:
মুফতি সাহেব বলেছেন যে, পৃথিবীতে
জাতিগত অহংকার (قوم پرستی) সবচেয়ে বেশি মানুষের ক্ষতি করেছে। ইসলাম মানুষকে জাতিগত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠার শিক্ষা দেয়। ইসলাম বলে যে, সকল মানুষ একই আদম (আঃ) এবং হাওয়া (আঃ) এর সন্তান  এই মূলনীতি মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং বিভাজন রোধ করে, কারণ সবার পূর্বপুরুষ এক হলে তাদের মধ্যে কোনো বিভেদ থাকতে পারে না।

শিক্ষিত মুসলমানের দায়িত্ব ও আত্মবিশ্বাস:
তিনি শ্রোতাদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেন, “শিক্ষিত মুসলমান ও অশিক্ষিত মুসলমানের মাঝে পার্থক্য থাকবে। একজন অশিক্ষিত মানুষ হয়তো শুধু শিখে নিয়েছেন, ‘আমার বাবা মুসলিম ছিলেন, আমিও তাই মুসলিম।’ কিন্তু আপনারা যখন ইসলাম মানেন, তখন আপনারা জানেন কেন মানছেন, কিসের ভিত্তিতে মানছেন। আপনারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলেন—আমার কাছে সাফল্যের অন্য কোনো বিকল্প নেই। আমি মুসলিম, কারণ ইসলামই সত্য।”

দ্বৈত শিক্ষা ব্যবস্থার সমন্বয়:
তিনি শিক্ষার দুটি দিক তুলে ধরেছেন:
বস্তুবাদী বা জাগতিক জ্ঞান: এটি হলো সেই জ্ঞান যা অর্থ উপার্জন, ব্যবস্থাপনা, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল শেখায়। এই জ্ঞান মানুষের জাগতিক জীবনে উন্নতির জন্য অপরিহার্য ।
মানুষকে মানুষ বানানোর জ্ঞান: এটি হলো সেই জ্ঞান যা আল্লাহ তায়ালা নবীদের মাধ্যমে এবং নবীদের উত্তরসূরি আলেমদের মাধ্যমে মানুষকে দিয়েছেন। মুফতি সাহেব জোর দিয়ে বলেছেন যে, কেবল জাগতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে একজন ভালো প্রকৌশলী বা ডাক্তার হওয়া যায়, কিন্তু একজন ভালো মানুষ হওয়া যায় নামানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করে ধর্মতিনি বলেন, “আজকের পৃথিবী চায় একহাতে বিজ্ঞান, আরেক হাতে নৈতিকতা। শুধু প্রোগ্রামিং জানলে মানুষ হয় না। শুধু সার্জারি পারলে হৃদয় বোঝা যায় না। মানুষ গড়ার জ্ঞান দরকার। এটা দিয়েছে নবীরা, নবীদের উত্তরসূরি আলেমরা। তাই আপনাকে একজন ভালো ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার পাশাপাশি ভালো মানুষও হতে হবে। এবং ভালো মানুষ হওয়া যায় ধর্মের আলোয়।”

ধর্ম শক্তিশালী অনুপ্রেরণা:
তিনি বলেছেন যে,
ধর্মের অনুপ্রেরণা অত্যন্ত শক্তিশালী, যা চিকিৎসক, বিজ্ঞানী বা সাধারণ মোটিভেশনাল স্পিকারদের অনুপ্রেরণার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর

ধর্মহীনতায় সম্পর্কের বিলুপ্তি:
কুরআনের উদাহরণ দিয়ে বলেন, “’উফ’ না বলো—এটি উদাহরণ (জজিয়াত), যার অর্থ আপনি এমন কোনো আচরণ করবেন না যা মা-বাবাকে কষ্ট দেয়। এইভাবে কুরআন নীতিগুলো দেয়, আর উদাহরণে বুঝিয়ে দেয়।”

তিনি বলেন, “পশ্চিমা বিশ্বে ছেলে-মেয়ে আলাদা থাকে, বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবা পড়ে থাকে। অথচ ইসলাম বলে, মা-বাবার ‘উফ’ বলাও গোনাহ। আমাদের সমাজে এ সম্পর্ক রক্ষা করে ধর্ম। ধর্ম চলে গেলে সম্পর্কও যাবে।”

পাকিস্তানে একাধিক উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “ধর্মহীনতার কারণে এমন অভিনেত্রীদের জানাজায় বাবা-মা পর্যন্ত যাননি। তারা বলেছেন, তারা ধর্মের বাইরে কাজ করেছে, তাই এ সম্পর্কও শেষ। এই ভয়াবহতা এড়াতে চাইলে পরিবার, সমাজ, আত্মা—সবকিছুতেই চাই ধর্ম।”

আল্লাহর সাথে সম্পর্ক:
মুফতি সাহেব জোর দিয়ে বলেছেন যে,
মানুষের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলো আল্লাহর সাথে । এই সম্পর্ক ইবাদতের মাধ্যমে, বিশেষ করে নামাজের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইবাদত অবশ্যই কেবল আল্লাহর জন্য হতে হবে, কোনো শরিক ছাড়া।

পেশা নয়, নিয়ত মুখ্য:
তিনি বলেন, “ইসলাম আপনাকে ডাক্তার হতে নিষেধ করে না, ইঞ্জিনিয়ার হতে বলে না। বরং বলে—আপনি যা হোন, আল্লাহর জন্য হোন। আপনি যদি একজন মানুষকে সুস্থ করেন, ডুবন্তকে উদ্ধার করেন, গাছ লাগান—এগুলো সবই সদকায়ে জারিয়া।” একটি জীবন বাঁচানোকে সমগ্র মানবতাকে বাঁচানোর সমান বলা হয়েছে। ডুবন্ত মানুষকে বাঁচানো বা অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করা, উভয়ই মানবসেবা এবং মহৎ কাজ । গাছ লাগানো, কৃষি বা চিকিৎসার মাধ্যমে সমাজের উপকার করাও সাদকা জারিয়া (চলমান সওয়াব)। সৎ উদ্দেশ্যে অর্থ উপার্জন করা, যেমন অন্যের কাছে হাত না পাতার জন্য বা মানুষের সেবার জন্য, সেটিও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের একটি উপায় এবং এর মাধ্যমে নবীগণের সাথে হাশরের সৌভাগ্য লাভ করা যায় ।

বিবাহ ও ভরসা:
শেষদিকে তিনি আল্লাহর উপর ভরসার আলোচনায় যান। বলেন, “আল্লাহ বলেছেন—‘তোমরা যদি গরিব হয়ে বিয়ে কর, আমি তোমাদের সচ্ছল করে দেবো।’ আজ আমরা বিয়ে করতে ভয় পাই, কিন্তু ভয় না করে আল্লাহর উপর ভরসা করাই ঈমানের পরিচয়।”

সবশেষে তিনি বলেন, “জাহাজে যদি কম্পাস না থাকে, তবে সেটা ভেসে থাকতে পারে, কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে না। আজকের শিক্ষাব্যবস্থাও জাহাজ। আর ধর্মীয় জ্ঞান সেই কম্পাস। আপনি কতটা গুনে গুনে ভাসছেন, তা নয়—আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন, সেটাই আসল।” একটি জাহাজের শুধু ভাসতে পারলেই হয় না, তার একটি দিকনির্দেশক কম্পাসও থাকতে হয় যা তাকে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। পার্থিব জ্ঞান আপনাকে জীবন সাগরে ভেসে থাকতে সাহায্য করে, কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞান হলো সেই কম্পাস যা আপনাকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে সঠিক পথে পরিচালিত করে

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT