বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি তাদের কর্মীদের জন্য একটি ড্রেস কোড নির্ধারণ করেছে, যার মাধ্যমে শালীনতা, পেশাদারিত্ব এবং অফিস পরিবেশে শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে এই নীতিমালাকে কেন্দ্র করে দেশের খ্যাতনামা কিছু গণমাধ্যম যেমন প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এবং কালের কন্ঠের মতো গণমাধ্যমকে ঘিরে একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই সংবাদমাধ্যমগুলো বিষয়টিকে নারীর স্বাধীনতা, আধুনিকতা এবং সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের প্রশ্ন হিসেবে তুলেছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে—বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনাটি কোনও ধর্মীয় বা সামাজিক শাসন নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক মানের কর্মপরিবেশ তৈরির চেষ্টার অংশ।
প্রথম আলো তাদের প্রতিবেদনে মন্তব্য করে যে ব্যাংক যেন “সাংস্কৃতিক বলয়” তৈরির মাধ্যমে কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করছে। এই মন্তব্য সাধারণ পাঠকের চোখে বিষয়টিকে শুধু আদর্শিক বিরোধ হিসেবে উপস্থাপন করে, যেখানে পেশাগত পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো কথাই বলা হয়নি। অন্যদিকে, দ্য ডেইলি স্টার এবং বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড এই নির্দেশনার সঙ্গে নারীর অধিকারকে জড়িয়ে ফেলে বিষয়টিকে অধিকতর সংবেদনশীল রূপ দেয়। তারা অভিযোগ তোলে যে “শালীন পোশাক” বলার মাধ্যমে নারীর স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে এবং প্রতিষ্ঠান নারীর ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ করছে।
কিন্তু সত্য হচ্ছে, ব্যাংক একটি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে সুনির্দিষ্ট আচরণবিধি থাকা স্বাভাবিক। ফেডারেল রিজার্ভ, রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া কিংবা ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যায়, পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করতে পোশাকবিধি কতটা প্রয়োজনীয়। বিশেষ করে তরুণ কর্মীরা যাদের মধ্যে এখনও বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কৃতির ছাপ রয়েছে, তাদের পেশাগত মানে উত্তরণে একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইন দরকার। এই ড্রেস কোড তাদের জন্য একটি শিক্ষণীয় দিকনির্দেশনা, যা ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক কর্মক্ষেত্রেও তাদের সহায়তা করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনার মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান স্পষ্টই বলেছেন—এটি কোনোরূপ ধর্মীয় বা রাজনৈতিক অভিপ্রায়ের অংশ নয়, বরং চাকরির পরিবেশ উপযোগী একটি নিয়ম। তিনি বলেন, অনেক নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত তরুণ-তরুণী অফিসে এমন পোশাক পরিধান করেন যা কর্মস্থলে সঠিক বার্তা দেয় না। এই নির্দেশনা সেই অনুপযুক্ততার একটি পেশাদার সমাধান।
জনগণের প্রতিক্রিয়াও গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডার বিপরীত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহু সাধারণ নাগরিক মন্তব্য করেছেন যে গণমাধ্যম নিজের অফিসে ড্রেস কোড চালু রাখে অথচ অন্যকে তা মানতে নিষেধ করে—এটি দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়। কেউ কেউ বলেন, স্বাধীনতা মানে ব্যক্তিত্বহীনতা নয়; বরং নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে থেকে শৃঙ্খলা বজায় রাখাই প্রকৃত স্বাধীনতা। এখানে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়। তারা কি সত্যিই পেশাগতভাবে দায়িত্ব পালন করেছে, নাকি একটি নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ চালাতে গিয়ে বাস্তবতা আড়াল করেছে? যখন দেশের বড় একটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নির্দেশনাকে নারীবিরোধী বলে উপস্থাপন করা হয়, তখন তা শুধু ব্যাংকের ভাবমূর্তি নষ্ট করে না, সমাজে বিভ্রান্তিও তৈরি করে। সাংবাদিকতা যেখানে তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণের জায়গা, সেখানে এমন একতরফা উপস্থাপনা হতাশাজনক।
নেটিজেনরা মনে করছেন, মিডিয়া যখন নারীর অধিকার প্রশ্ন তোলে, তখন তাদের উচিত এই প্রশ্ন করা—শালীনতা কি শুধুই পোশাকে সীমাবদ্ধ? একটি নারী কীভাবে তার কাজের মাধ্যমে সমাজে প্রভাব ফেলবে, সেটাই আসল। ব্যাংক কখনও বলেনি ওড়না না পরলে চাকরি হবে না; বরং এমন পোশাক পরিধান করতে বলেছে যা কর্মক্ষেত্রে মানানসই এবং পেশাগত পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। গণমাধ্যমের এই আচরণে সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে—যেখানে ব্যাংকের পেশাদার নীতিমালাকে ধর্মীয় বা রক্ষণশীল প্রেক্ষাপটে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এতে করে একদিকে যেমন কর্মক্ষেত্রে শৃঙ্খলা রক্ষার চেষ্টাকে তুচ্ছ করা হয়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের অনাস্থা জন্মায়। এ ধরনের সংবাদপত্রীয় আক্রমণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
নেটিজেনরা আরো বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ড্রেস কোড পেশাদার পরিবেশ নিশ্চিত করার একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। এটি পুরুষ বা নারী কোনও পক্ষের স্বাধীনতা খর্ব করে না; বরং সবাইকে একটি মানসম্মত আচরণবিধির মধ্যে আনতে সাহায্য করে। গণমাধ্যমের উচিত বিষয়টিকে রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক বিরোধের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করা। মিডিয়া যদি সমাজের পথপ্রদর্শক হতে চায়, তাহলে তাদের আগে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির দায়শোধ করতে হবে। কারণ সত্যিকার সাংবাদিকতা কখনও উদ্দেশ্যমূলক নয়—তা বরাবরই যুক্তিভিত্তিক এবং সমাজকল্যাণমুখী।