ফিলিস্তিনি দুই ভাই গ্রেফতার “ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি” শিরোনামের একটি বইকে সন্ত্রাসবাদ উসকে দেওয়ার অভিযোগে ইসরায়েলি পুলিশ গ্রেফতার করেছে তাদের।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ পূর্ব জেরুজালেমের একটি বিখ্যাত বইয়ের দোকানের মালিক মাহমুদ ও আহমাদ মুনা’কে গ্রেফতার করেছে। এই গ্রেফতার দখলকৃত অঞ্চলে ফিলিস্তিনিদের ওপর দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় তুলেছে।
তাদের গ্রেফতারের মূল কারণ হল “ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি” নামে একটি শিশুদের রঙিন ছবি আঁকার বই, যা তাদের দোকানে বিক্রি হচ্ছিল।
ইসরায়েলি পুলিশ এডুকেশনাল বুকশপ নামে ওই বইয়ের দোকানের মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে যে তারা “সন্ত্রাসবাদে উসকানি দেওয়া ও সমর্থনকারী বই বিক্রি করেছে”।
“ফ্রম দ্য রিভার টু দ্য সি” বাক্যটি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়, বিশেষ করে গাজা যুদ্ধ চলাকালীন এটি আরও বেশি আলোচনায় আসে। গত ১৫ মাসে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় ৪৮,০০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।
গত কয়েক মাসে ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভকারীদের এই বাক্য ব্যবহার করায় কঠোরভাবে দমন করেছে। অনেক জায়গায় এই স্লোগান লেখা ব্যানার পর্যন্ত নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পারিবারিক বইয়ের দোকানটি দীর্ঘদিন ধরে একটি মেধাবী আলোচনার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানে কূটনীতিক, সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদরা নিয়মিত আসতেন, কারণ এখানে ফিলিস্তিনি ইতিহাস ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত নিয়ে প্রচুর বই পাওয়া যেত।
গ্রেফতার হওয়া মুনা ভাইদের ভাই মোরাদ মুনা বলেন,
“তারা যে কোনও বই যেখানে ফিলিস্তিনি পতাকা বা প্রতীক ছিল, তা গুগল অনুবাদ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল।”
মুনা ভাইদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই একে ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক প্রকাশ ও স্বাধীনতার ওপর ইসরায়েলের দমনমূলক নীতি বলে অভিহিত করেছেন।
যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হুসাম জমলট বলেছেন,
“মাহমুদ ও আহমাদ মুনা’র গ্রেফতার প্রমাণ করে যে ইসরায়েল জ্ঞানচর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দমন করছে। তারা এমন যেকোনো তথ্যকে সেন্সর করতে চায়, যা দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে যায়।”
We condemn in the strongest terms the arrest of my friends Mahmoud Muna and Ahmad Muna, Palestinian booksellers and owners of Jerusalem’s Educational Bookshop, by Israel’s occupation authorities.
The arrests of Mahmoud and Ahmad is a stark reminder of the ongoing campaign to… pic.twitter.com/bSRZE7tAOa
— Husam Zomlot (@hzomlot) February 10, 2025
গ্রেফতারের পর বিচার শুনানিতে যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, সুইজারল্যান্ডসহ নয়টি দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন।
জার্মানির ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত স্টেফেন সাইবার্ট বলেন,
“আমি মুনা পরিবারের মানুষদের চিনি। তারা শান্তিপ্রিয় ও যুক্তিবাদী ফিলিস্তিনি জেরুজালেমবাসী। এই গ্রেফতারের খবর শুনে আমি গভীর উদ্বিগ্ন।”
মুনা ভাইদের আইনজীবী জেলা আদালতে আপিল করে তাদের মুক্তির আবেদন করলেও সোমবার সেটি প্রত্যাখ্যান করা হয়।
একজন টুইটার ব্যবহারকারী লিখেছেন,
“মধ্যপ্রাচ্যের তথাকথিত একমাত্র গণতন্ত্রে একটি বইয়ের দোকানের মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছে! তার অপরাধ? … দক্ষিণ আফ্রিকার লেখক নাথি ন্গুবানে’র একটি শিশুদের রঙিন বই বিক্রি করা।”
অন্য একজন মন্তব্য করেছেন,
“এটি ইসরায়েলি পুলিশের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট থেকে করা টুইট, যেখানে তারা পূর্ব জেরুজালেমের একটি বইয়ের দোকানে অভিযান চালিয়ে এর মালিকদের গ্রেফতার করার কারণ ব্যাখ্যা করেছে… আর সেই কারণ? একটি রঙিন ছবি আঁকার বই!”
সোমবার মুনা ভাইদের মুক্তির দাবিতে আদালতের বাইরে সমবেত হন তাদের সমর্থকরা। প্রতিবাদকারীদের মধ্যে পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক নাথান থ্রল-ও ছিলেন, যিনি ওই দোকানেই তার বই “আ ডে ইন দ্য লাইফ অফ আবেদ সালামা” প্রকাশ করছিলেন।
তিনি বলেন,
“ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেমে ভয় ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করছে। এই বইয়ের দোকানটি সবার পরিচিত ছিল। এখন তারা এমন একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, যার কূটনৈতিক ও ইসরায়েলি বামপন্থী মহলে যোগাযোগ আছে। এর মাধ্যমে আরও ভয়ঙ্কর বার্তা দেওয়া হচ্ছে।”
সমগ্র অধিকৃত পশ্চিম তীরে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। এখন পর্যন্ত সেখানে ৯১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৭,০০০-এর বেশি আহত হয়েছেন ইসরায়েলি বাহিনী ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের হাতে।
ইসরায়েলি শাসনে ফিলিস্তিনি সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে দমন-পীড়নের শিকার। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এসব আক্রমণ আরও বেড়েছে।
ফিলিস্তিনি সাংবাদিকদের গ্রেফতার, গণমাধ্যম অফিস বন্ধ এবং প্রতিবাদ দমন করা হচ্ছে ব্যাপকভাবে।
ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেতজ জানায়,
“পুলিশ বইগুলোর ওপর গুগল অনুবাদ ব্যবহার করে যেগুলো তাদের অপছন্দ হয়েছে, সেগুলো বাজেয়াপ্ত করেছে।”
প্রথমে আদালত বইয়ের দোকান তল্লাশির জন্য পরোয়ানা জারি করেছিল, কিন্তু কোনো উসকানিমূলক প্রমাণ না পাওয়ায় অভিযোগ পরিবর্তন করে “সার্বজনীন শান্তি বিনষ্ট” করা হয়।
মুনা ভাইদের আইনজীবী বলেন,
“আমি কখনও দেখিনি যে কেউ শুধু ‘শান্তি বিনষ্ট’ করার অভিযোগে রাতভর আটক থাকে।”
প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও পুলিশ মুনা ভাইদের জেলে রেখে তাদের আটকাদেশ বাড়ানোর আবেদন করেছে।
আরো পড়নঃ
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড
Leave a Reply