কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে, এটি কি বিমান দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানি প্রতিরোধ করতেও সক্ষম?
এ বছর ইতোমধ্যেই ১০০-র বেশি মানুষ বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে ওয়াশিংটন ডিসির কাছে একটি বাণিজ্যিক এয়ারলাইনার ও একটি হেলিকপ্টারের মাঝআকাশে সংঘর্ষ এবং সাও পাওলোতে একটি বিমান বাসের সঙ্গে ধাক্কা লাগার ঘটনা উল্লেখযোগ্য।
নতুন বছরের প্রথম দুই মাসে বেশ কিছু মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে গত বছরকে বিমান চলাচলের ইতিহাসের অন্যতম প্রাণঘাতী বছর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে অন্তত ৩১৮ জন মানুষ ১১টি বেসামরিক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন, যার মধ্যে দুইটি দুর্ঘটনা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ঘটে।
যদিও মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা বিরল, তবে এগুলো ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং অনেকের উড়োজাহাজে ভ্রমণের ভয় বাড়িয়ে দেয়। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে কমপক্ষে ২৫ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি উড়োজাহাজে ভ্রমণের ভয় পান। শুধু দুর্ঘটনাই নয়, জরুরি অবতরণ, বিমানের দরজা খুলে যাওয়া বা রানওয়ে থেকে বিমান ছিটকে পড়ার মতো ঘটনা এই ভয়কে আরও তীব্র করে তোলে।
শিল্প বিশেষজ্ঞ ও তদন্ত সংস্থাগুলোর মতে, বেশিরভাগ বিমান দুর্ঘটনার জন্য মানবিক ভুল দায়ী।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতোমধ্যেই বিমান শিল্পে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে – রুট অপটিমাইজেশন, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ ও টেকসই ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। তবে, এটি কি বিমান চলাচলকে আরও নিরাপদ করতে পারে এবং প্রাণহানি প্রতিরোধ করতে সক্ষম?
LYTE Aviation-এর সিইও ও প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেশতা ফারজাম আল জাজিরাকে বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতোমধ্যেই বিমান চলাচলে দুর্ঘটনা হ্রাস ও প্রাণহানি কমানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ, ভবিষ্যদ্বাণীমূলক রক্ষণাবেক্ষণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সহায়তা করছে। বিমান ট্রাফিক কন্ট্রোল (ATC) ও সংঘর্ষ এড়াতে এটি ব্যাপক ভূমিকা রাখছে।”
একটি গবেষণাপত্র Artificial Intelligence in Aviation Safety: Systematic Review and Biometric Analysis অনুসারে, “বিমান শিল্পের অগ্রগতির সাথে সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো প্রযুক্তিগত উন্নয়ন গ্রহণ করা অপরিহার্য।”
আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থার (IATA) মতে, ২০২৩ সালে প্রতি ১২.৬ মিলিয়ন ফ্লাইটে মাত্র একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল, যা এক দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন হার ছিল। তবে পরবর্তী ১৪ মাসে ৪০০-এর বেশি প্রাণহানি ঘটে।
প্রায় ৮০% বিমান দুর্ঘটনার জন্য মানবিক ভুলকে দায়ী করা হয়, যার মধ্যে ৫৩% দুর্ঘটনার মূল কারণ পাইলটের ভুল বলে মনে করা হয়।
বিমান শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা প্রসঙ্গে Airport AI Exchange-এর প্রধান AI কর্মকর্তা আমাদ মালিক বলেন, “বিমান শিল্পে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে, যদিও বাণিজ্যিক বিমানে তা এখনো পুরোপুরি প্রয়োগ করা হয়নি। কারণ, এখানে বহু বছরের তথ্য ও গবেষণার প্রয়োজন হয়। তবে একটি স্বায়ত্তশাসিত স্থানীয় বুদ্ধিমত্তার ধারণা রয়েছে, যা পাইলট বা ATC-এর ভুল শনাক্ত ও সংশোধন করতে পারে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা কোনো কিছু সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করছি না, বরং বিদ্যমান প্রযুক্তির সঙ্গে নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করছি। তবে বিমান শিল্পে কার্যকর পরিবর্তন আনতে হলে আমাদের অতীত থেকে শিখতে হবে, তা গ্রহণ করতে হবে এবং উন্নতি করতে হবে।”
বর্তমানে বিমান চলাচলে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, যার মধ্যে উড়ন্ত ট্যাক্সি বাজার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ২০২৯ সালের মধ্যে এই বাজার ৪.৯ বিলিয়ন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৮০.৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে Spherical Insights।
ফারজাম বলেন, “বিমান দুর্ঘটনার প্রধান কারণ মানবিক ভুল, অবসাদ ও ভুল সিদ্ধান্ত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই ঝুঁকি দূর করতে পারে, যার ফলে উড়োজাহাজ ভ্রমণ আরও নিরাপদ হবে। তবে মূল সমস্যা হলো বিশ্বাস। মানুষের জন্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের একটি সংকর (hybrid) ধাপ দরকার, পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় যাওয়ার আগে। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে স্বয়ংক্রিয় বিমান ট্যাক্সি ও আকাশবাস দেখা যাবে, তবে তার আগে মানুষকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে হবে।”
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বোয়িংয়ের সিইও ডেভ ক্যালহাউন বলেন, “নাগরিক বিমান চলাচলের জন্য স্বায়ত্তশাসন বাস্তবতা হয়ে উঠবে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ। সবাইকে আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে হবে এবং আমরা এমন একটি সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া তৈরি করতে চাই যাতে সবাই আস্থা রাখতে পারে।”
বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় বিমানের ধারণাটি কিছু মানুষের কাছে অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। তবে এটি কিভাবে মানুষের সক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে – সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবা গুরুত্বপূর্ণ।”
বাণিজ্যিক বিমানগুলোর অনেক কাজ ইতোমধ্যেই স্বয়ংক্রিয়, যেখানে উন্নত অটোপাইলট ও ফ্লাইট কন্ট্রোল সিস্টেম প্লেন পরিচালনা করে। এমনকি খারাপ আবহাওয়ায়ও বিমান নিরাপদে অবতরণ করতে সক্ষম।
How hard can it be to land A350 without a pilot?
– We just did it thanks to Deep Learning!😎@Airbus completes world's first fully automatic, VISION-BASED autonomous taxi, takeoff and landing with A350 test aircraft under ATTOL project, CTO @graziavittadini says#AiaaAviation pic.twitter.com/Xs561EKvea
— Oktay Arslan (@oktayarslan) June 18, 2020
তবে, মালিকের মতে, “বিমান চলাচলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত করা এখনই খুব একটা কার্যকর হবে না, কারণ এটি অনেক জটিলতা তৈরি করতে পারে। বিমান ও এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল একসঙ্গে কাজ না করলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হবে না।”
ফারজাম বলেন, “মানুষের সহায়ক হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজ করতে পারে। বিশেষ করে জরুরি পরিস্থিতিতে AI-চালিত সহকারী পাইলটের ভূমিকা মানবিক ভুল কমাতে সহায়ক হতে পারে।”
তিনি আরও যোগ করেন, “নতুন যুগ শুরু হয়েছে, এবং আশা করা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধু বিমান নিরাপত্তা বৃদ্ধিতেই নয়, বরং বিমান চলাচলের টেকসই উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
সূত্র: আল জাজিরা
Leave a Reply