বাঁকানো সীমানা, সোজা রেখা এবং স্থলবেষ্টিত দেশগুলো— আফ্রিকার মানচিত্রের পেছনের গল্পগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বের যে কোনো মহাদেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি দেশ রয়েছে, মোট ৫৪টি।
এর অনেক সীমান্ত প্রাকৃতিক ভূপ্রকৃতি বা ঐতিহাসিক সীমারেখা অনুসরণ না করে কিছু স্থানে একেবারে সোজা এবং অন্যত্র আঁকাবাঁকা, যা পাহাড়, নদী এমনকি সম্প্রদায়গুলোর মধ্য দিয়ে কেটে গেছে।
এই কৃত্রিম সীমান্তগুলোর বেশিরভাগের উৎস ১৮৮৪-১৮৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলন, যা আজ থেকে ১৪০ বছর আগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিগুলো আফ্রিকা মহাদেশকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল, অথচ কোনো আফ্রিকান দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বা প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় ২,০০০ বর্গকিলোমিটার (৭৯৫ বর্গমাইল) আকারের একটি জনশূন্য, শুষ্ক ভূখণ্ড রয়েছে, যেটি মিসর বা সুদান কেউই নিজেদের বলে দাবি করে না।
১৮৯৯ সালে, ব্রিটেন ২২° উত্তর অক্ষাংশ বরাবর একটি সোজা সীমারেখা টেনে মিসর ও সুদানের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছিল, যেগুলো তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল।
কিন্তু ১৯০২ সালে, ব্রিটেন ভূ-রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণ দেখিয়ে উপকূলবর্তী ও সম্পদসমৃদ্ধ হালাইব ত্রিভুজ সুদানকে এবং বির তাওইল মিসরকে হস্তান্তর করে।
পরবর্তীতে, উভয় দেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর, মিসর ১৮৯৯ সালের সীমারেখাকেই প্রকৃত সীমান্ত হিসেবে দাবি করে, অন্যদিকে সুদান ১৯০২ সালের সীমারেখা অনুসরণ করতে চায়। কিন্তু বির তাওইলকে স্বীকৃতি দিলে হালাইব ত্রিভুজের মালিকানা হারাতে হবে, তাই কেউই একে নিজেদের বলে দাবি করে না।
২০০০ সাল থেকে মিসর হালাইব ত্রিভুজ নিয়ন্ত্রণ করে আসছে, তবে বিরোধ আজও মীমাংসিত হয়নি।
আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল বরাবর ভ্রমণ করলে, গাম্বিয়া নদীর চারপাশে গঠিত একটি সরু ভূখণ্ড দেখা যায়, যা প্রায় পুরোপুরি সেনেগাল দ্বারা বেষ্টিত। এটি গাম্বিয়া, মূল ভূখণ্ড আফ্রিকার ক্ষুদ্রতম দেশ, যেখানে প্রায় তিন মিলিয়ন মানুষ বসবাস করে।
১৫ শতকে পর্তুগিজরা প্রথম গাম্বিয়া অঞ্চলটি অন্বেষণ করে, পরে এটি আটলান্টিক দাস বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৮২১ সাল থেকে এটি ব্রিটিশ উপনিবেশ হিসেবে ছিল এবং ১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ফরাসি শাসিত সেনেগালের নিকটবর্তী হওয়ায়, এর সীমান্ত ব্রিটিশ ও ফরাসি কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিতর্কের বিষয় হয়ে ওঠে।
১৮৮৯ সালে, ব্রিটেন ও ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে গাম্বিয়ার সীমানা নির্ধারণ করে, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ গাম্বিয়া নদীর দুই পাশে প্রায় ১৬ কিমি (১০ মাইল) পর্যন্ত বিস্তৃত থাকবে এবং এর শেষ নৌযানযোগ্য স্থান ইয়ারবুটেন্ডা পর্যন্ত পৌঁছাবে।
একটি জনপ্রিয় কাহিনিতে বলা হয়, ব্রিটিশ বাহিনী তাদের জাহাজ থেকে কামানের গোলা ছুঁড়ে দেশটির প্রস্থ নির্ধারণ করেছিল, যাতে তারা গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। যদিও এর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, তবে ১৮৯১ সালে একটি অ্যাংলো-ফরাসি কমিশন সীমান্ত আরও নির্ধারণের চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্থানীয় শাসকরা এর বিরোধিতা করেন, কারণ এতে তাদের ভূমি নির্বিচারে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছিল।
অবশেষে, গাম্বিয়ার সীমান্ত ব্রিটিশ উপনিবেশবাদী স্বার্থ ও সামরিক শক্তির মাধ্যমে গঠিত হয়, যার ফলে এটি সেনেগালের মধ্যে একটি দীর্ঘ, সরু ভূখণ্ড হয়ে থাকে।
আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে দক্ষিণ দিকে গেলে, অ্যাঙ্গোলার মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ছোট অঞ্চল দেখতে পাবেন। এটি কাবিন্দা, অ্যাঙ্গোলার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ, যা কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের একটি সরু ভূখণ্ড দ্বারা মূল অ্যাঙ্গোলা থেকে বিচ্ছিন্ন।
কাবিন্দা পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় নেওয়া ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে অ্যাঙ্গোলার অংশ হয়ে ওঠে।
১৮৮৪-১৮৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনের সময়, কাবিন্দাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পর্তুগিজ অধিকৃত অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা অ্যাঙ্গোলা থেকে পৃথক ছিল, যদিও উভয়ই পর্তুগিজ নিয়ন্ত্রণে ছিল। পরে, পর্তুগাল প্রশাসনিকভাবে কাবিন্দাকে অ্যাঙ্গোলার সঙ্গে একীভূত করে, কিন্তু ভূখণ্ডটি ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিকভাবে স্বতন্ত্র রয়ে যায়।
১৯৭৫ সালে, পর্তুগাল যখন তার আফ্রিকান উপনিবেশগুলো থেকে সরে যায়, তখন অ্যাঙ্গোলার প্রধান স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষরিত আলভার চুক্তিতে কাবিন্দার প্রতিনিধিত্ব অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলে, এটি অ্যাঙ্গোলার অংশে পরিণত হয়, মূলত এর মূল্যবান অফশোর তেলসম্পদের কারণে।
এর ফলে কাবিন্দার স্বাধীনতাকামী আন্দোলন, বিশেষত “ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব দ্য এনক্লেভ অব কাবিন্দা” নামে একটি গোষ্ঠী গঠিত হয়, যারা এখনো কাবিন্দার স্বাধীনতার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করলে আপনি নামিবিয়া থেকে বেরিয়ে আসা একটি সরু ভূখণ্ড লক্ষ্য করতে পারেন। এটি ক্যাপ্রিভি স্ট্রিপ নামে পরিচিত।
২০শ শতকের শুরুর আগে পর্যন্ত, জার্মানি “জার্মান দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা” (বর্তমান নামিবিয়া) এবং “জার্মান পূর্ব আফ্রিকা” (বর্তমান তানজানিয়া, রুয়ান্ডা এবং বুরুন্ডি) নিয়ন্ত্রণ করত, আর ব্রিটেন চারপাশের অঞ্চলগুলোর নিয়ন্ত্রণে ছিল, যার মধ্যে বর্তমান বতসোয়ানা এবং জাম্বিয়া অন্তর্ভুক্ত।
জার্মানি তার অঞ্চলগুলোর মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যিক রুট স্থাপনের জন্য জাম্বেজি নদীতে প্রবেশাধিকার চেয়েছিল, যাতে এই নদী ব্যবহার করে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত সহজে পৌঁছানো যায় এবং তানজানিয়ার সঙ্গে সংযোগ তৈরি হয়।
১৮৯০ সালে, জার্মানি ও ব্রিটেন একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে জার্মানি জাঞ্জিবারের দাবির বিনিময়ে উত্তর সাগরের হেলিগোল্যান্ড দ্বীপ এবং জাম্বেজি নদীর সংযোগস্থলে ক্যাপ্রিভি স্ট্রিপের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।
তবে, জার্মানির এই পরিবহন পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। বলা হয়ে থাকে যে, কেউ জার্মানদের ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত সম্পর্কে জানায়নি—বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জলপ্রপাত, যা ক্যাপ্রিভি স্ট্রিপের প্রায় ৬৫ কিমি (৪০ মাইল) পূর্বে অবস্থিত এবং যার ১০৮ মিটার (৩৫৪ ফুট) উঁচু থেকে জল পতিত হয়, ফলে নদীটি পরিবহনের জন্য সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায়।
দক্ষিণ আফ্রিকার পার্বত্য অঞ্চলের মধ্যে একটি ছোট স্থলবেষ্টিত দেশ রয়েছে, যা পুরোপুরি দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বারা বেষ্টিত—এটি লেসোথো।
১৯ শতকে, বাসোথো জনগণ রাজা মোশোশো প্রথম-এর নেতৃত্বে পার্বত্য অঞ্চলে তাদের শক্ত ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করে এবং পর্বতগুলিকে ব্যবহার করে জুলু এবং বোয়ের (ডাচ কৃষক) উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলে।
বোয়ের সম্প্রসারণ রোধ করার জন্য, মোশোশো ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ সুরক্ষা প্রার্থনা করেন, যার ফলে বাসুতোল্যান্ড ব্রিটিশ প্রটেক্টোরেট (সুরক্ষিত এলাকা) হয়ে ওঠে।
এটিকে কেপ কলোনির অধীনে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়, কারণ বাসোথো জনগণ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত, ১৮৮৪ সালে, ব্রিটেন এটিকে একটি “ক্রাউন কলোনি” ঘোষণা করে।
১৯১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা ইউনিয়ন গঠিত হলে, বাসুতোল্যান্ড ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণে থেকে যায় এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী (এপার্টহেইড) নীতির বাইরে থাকতে সক্ষম হয়। অবশেষে, ১৯৬৬ সালে এটি স্বাধীনতা লাভ করে এবং লেসোথো নামে পরিচিত হয়।
বিশ্বে চারটি দেশের নামের মধ্যে “গিনি” শব্দটি রয়েছে, যার মধ্যে তিনটি পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে অবস্থিত।
এগুলো হলো:
বিশ্বের অন্য প্রান্তে পাপুয়া নিউ গিনি রয়েছে, যার নাম ১৬শ শতকের এক স্প্যানিশ অভিযাত্রী দ্বারা রাখা হয়। তিনি পশ্চিম আফ্রিকার গিনির মানুষের সঙ্গে এখানকার স্থানীয়দের চেহারার মিল লক্ষ্য করে নামটি দেন।
“গিনি” নামটি সম্ভবত পর্তুগিজ শব্দ “Guiné” থেকে এসেছে, যা পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলবর্তী অঞ্চলকে বোঝাত। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা যখন এই অঞ্চলকে ভাগ করে নেয়, তখন প্রত্যেকেই নিজেদের অঞ্চলকে “গিনি” নামে ডাকে।
মজার তথ্য:
ব্রিটিশ “গিনি” মুদ্রা, যা প্রথম ১৬৬৩ সালে তৈরি হয়েছিল, তার নাম পশ্চিম আফ্রিকার গিনি অঞ্চল থেকে এসেছে, কারণ এই মুদ্রার জন্য ব্যবহৃত সোনা ওই অঞ্চল থেকেই সংগৃহীত হত।
কঙ্গো নদীর দুই পাশে দুটি দেশ রয়েছে, যাদের নাম এর থেকে এসেছে—গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (DRC) এবং কঙ্গো প্রজাতন্ত্র (Republic of Congo)।
উপনিবেশিক শক্তি বেলজিয়াম ও ফ্রান্স নদীর দুই পাশে পৃথক উপনিবেশ স্থাপন করেছিল এবং উভয়ই “কঙ্গো” নাম ব্যবহার করে।
“কঙ্গো” নামটি এসেছে কঙ্গো রাজ্য থেকে, যা একসময় নদী বরাবর একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল।
লেখক: মরিয়ম আলি, প্রতিবেদক, আল জাজিরা