বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বজুড়ে সামাজিক ব্যবসার প্রবর্তক অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্পকে এক গুরুত্বপূর্ণ ও কূটনৈতিক চিঠি পাঠিয়েছেন। এতে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক আরও মজবুত করার উদ্দেশ্যে পারস্পরিক শুল্কনীতি পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছেন।
চিঠিতে ড. ইউনুস অত্যন্ত সুসংহত ভাষায় বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক এজেন্ডাকে পূর্ণ সমর্থন জানাতে প্রস্তুত এবং সেই লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই গ্রহণ করেছে। তিনি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তার অভিষেকের কিছুদিন পরেই বাংলাদেশ তার উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে মার্কিন পণ্যের জন্য ১৭ কোটি মানুষের বাজার উন্মুক্ত করার প্রস্তাব দিয়েছিল, যা ছিল মার্কিন বাণিজ্যের পক্ষে এক সাহসী ও দূরদর্শী পদক্ষেপ।
চিঠিতে উল্লেখ করা হয় যে, বাংলাদেশই প্রথম দেশ যারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানির জন্য বহু বছরের চুক্তিতে প্রবেশ করে। সেই সঙ্গে এলএনজি রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর দুই দেশের মধ্যে আরও বিস্তৃত সহযোগিতার পথ তৈরি হয়েছে।
ড. ইউনুস অত্যন্ত কৌশলীভাবে তুলে ধরেন যে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকরা মার্কিন কর্তৃপক্ষের সাথে একযোগে কাজ করছেন যেন দ্রুত ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে মার্কিন রপ্তানি বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়। বাংলাদেশের পণ্য বাজারে প্রবেশে মার্কিন ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে বিশেষভাবে শুল্কমুক্ত গুদাম সুবিধা চালু করার পরিকল্পনার কথাও জানানো হয়।
চিঠির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা, গম, ভুট্টা ও সয়াবিনসহ নানা কৃষিপণ্য আমদানি বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি। তিনি ব্যাখ্যা করেন, এসব পণ্যের আমদানি মার্কিন কৃষকদের আয় বাড়াবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে স্থায়িত্ব আনবে।
আরও পড়ুনঃ
বাংলাদেশে রপ্তানি বন্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতীয় কৃষক, রাজ্যজুড়ে বিক্ষোভ
মার্কিনীদের হয়ে কাজ করা আফগানদের দেশত্যাগে বাধ্য করছে ট্রাম্প প্রশাসন
বাংলাদেশের বাণিজ্যনীতির প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে গিয়ে ড. ইউনুস জানান, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ পণ্যে সর্বনিম্ন শুল্ক আরোপ করে থাকে। কৃষিপণ্যের ওপর শূন্য শুল্ক এবং ধাতব স্ক্র্যাপসহ বিভিন্ন পণ্যে শুল্ক হ্রাসের বিষয়টিও তিনি তুলে ধরেন।
এছাড়া, তিনি জানান, গ্যাস টারবাইন, সেমিকন্ডাক্টর এবং মেডিকেল যন্ত্রপাতির মতো গুরুত্বপূর্ণ আমদানি পণ্যে ৫০% শুল্ক হ্রাসের কার্যক্রম চলমান। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন নন-ট্যারিফ প্রতিবন্ধকতা দূর করতে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই পরীক্ষামূলক মান যাচাই, প্যাকেজিং, লেবেলিং ও সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া সহজতর করেছে।
চিঠিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো, বাংলাদেশে মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি স্টারলিংক-এর কার্যক্রম চালু করার উদ্যোগের কথা। ড. ইউনুস একে ‘উচ্চপ্রযুক্তি খাতে এক নতুন যুগের সূচনা’ হিসেবে অভিহিত করেন, যা বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তর এবং মার্কিন প্রযুক্তি বিনিয়োগের জন্য এক অনন্য সুযোগ।
চিঠির শেষাংশে, অধ্যাপক ইউনুস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে আহ্বান জানান, তিন মাসের জন্য বাংলাদেশের উপর পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হোক, যাতে দুই দেশ এই পরিবর্তনগুলো বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পায় এবং যৌথভাবে কাজ করে।
চিঠিটির প্রতিটি বাক্যে ড. ইউনুসের দূরদর্শী কূটনৈতিক দক্ষতা ও গভীর রাষ্ট্রনৈতিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন দেখা যায়। একজন চিন্তাশীল অর্থনীতিবিদ হিসেবে তিনি যেমন উন্নয়ন ও মানবকল্যাণে বিশ্বজোড়া ভাবনার মানুষ, তেমনি একজন দক্ষ প্রশাসক ও কৌশলী রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেও তার অবস্থান বারবার প্রমাণিত হয়েছে।
এই চিঠি শুধু কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটি নিখুঁত দৃষ্টান্ত নয়, বরং বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় ইতিবাচক, প্রো-অ্যাকটিভ অবস্থান নেওয়ার প্রমাণ। ড. ইউনুসের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।