সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এক সংসদীয় কমিটির বৈঠকে স্বীকার করেছেন যে, শেখ হাসিনার সরকার টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভারতীয় প্রশাসনের সীমাবদ্ধতা ছিল এবং পরিস্থিতি তাদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল। তার এই মন্তব্য ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
জয়শঙ্করের বক্তব্য অনুসারে, ভারত আগেই আঁচ করেছিল যে, শেখ হাসিনার সরকার টিকে থাকতে পারবে না। তিনি বলেন, “আমরা জানতাম হাসিনার সরকার টিকবে না। তবে আমাদের কিছু করার ছিল না। পরিস্থিতি আমাদের হাতের বাইরে চলে গিয়েছিল।”
ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর শীর্ষ কর্মকর্তা রমনশ্রান্ত আগারওয়াল জানিয়েছেন, “আমরা হাসিনাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, গুলি চালাবেন না। কিন্তু তিনি আমাদের কথা রাখলেন না এবং বুলেট চালালেন।” এ প্রসঙ্গে জয়শঙ্করও সংসদীয় বৈঠকে বলেন, “আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু হাসিনা সরকার তখন এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল, যেখানে কেউই তাঁকে বাঁচাতে পারত না। মোদি তবু চেষ্টা করেছিলেন।”
এই মন্তব্যের আগেই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করেছে যে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)-তে নিয়ে যাওয়া হবে। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় হওয়া সহিংসতার ঘটনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।
লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ব্যারিস্টার আশরাফুল আরেফিন ও দুই ব্রিটিশ অ্যাটর্নি এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা ও তার সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের তদন্ত দাবি করা হচ্ছে।
এছাড়া, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। প্রসিকিউশন টিম এই মামলাগুলোর প্রাথমিক বিশ্লেষণ করছে এবং অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হলে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে।
ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা শেখ হাসিনার বিষয়ে দিল্লির অবস্থান এখনও অস্পষ্ট। তবে জয়শঙ্কর স্পষ্ট করেছেন যে, “আমরা কোনোভাবেই আইসিসি-তে যাব না, হাসিনার সাথে হেগে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।”
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেন, “২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মোদির ৩৮টি বিদেশ সফরে মোট ২৫৮ কোটি রুপি খরচ হয়েছে। আইসিসি-তে অংশগ্রহণ করতে হলে প্রতি বার ১২ থেকে ১৫ কোটি রুপি ব্যয় হবে, যা প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণ বাজেটের সঙ্গে সমন্বয় করা সম্ভব নয়। তাছাড়া মোদি বেড়াতে ভালবাসেন, তবে আদালতে নয়।”
শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লিতে ‘বিশেষ অতিথি’ মর্যাদায় থাকলেও কার্যত বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন বলে জানা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছে যে, “প্রথম দিকে শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হলেও, ধীরে ধীরে সেগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে। এখন তাকে নিজের রান্না করে খেতে হয়, এমনকি দুধ-মুড়ি খেয়ে দিন কাটানোর কথাও শোনা যাচ্ছে।”
গেস্ট হাউজের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক জয়রাজ মালহোত্রার দাবি, হাসিনা সম্প্রতি জয়শঙ্করকে ফোন করে দেশে ফেরার ব্যাপারে চাপ দেন। জয়শঙ্কর তখন রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বলেন, “ম্যাডাম, আপনি যদি দেশের মানুষের কথা শুনতেন, তাহলে আজ দুধ-মুড়ি খেয়ে জীবন কাটাতে হতো না। আপনি দেশেই থাকতেন। এখন দেশে নয়, আপনাকে আইসিসিতে পাঠানোর টিকিট কাটা নিয়ে আলোচনা চলছে।”
ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আইসিসি-তে বিচার শুরু হলে ভারতও চাপের মুখে পড়বে। মুম্বাইভিত্তিক স্বাধীন তদন্ত সংস্থা ‘ট্রু জাস্টিজ’-এর মুখপাত্র জানিয়েছেন, “শেখ হাসিনার সকল বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ভারত সহযোগিতা করেছিল। ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় ভারতও এড়াতে পারবে না। বাংলাদেশ যদি শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে ভারতকেও আইসিসির কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে।”
শেখ হাসিনার অবস্থান এখন অনিশ্চিত। ভারতের নীরবতা এবং বাংলাদেশ সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, “আইসিসি যদি সত্যিই সক্রিয় হয়, তাহলে হাসিনার পরবর্তী গন্তব্য দিল্লির গেস্ট হাউস নয়, বরং হেগের ট্রাইব্যুনাল হবে।”
এখন দেখার বিষয়, ভারত কূটনৈতিকভাবে এই সংকট কীভাবে মোকাবিলা করে এবং শেখ হাসিনার ভবিষ্যৎ কী নির্ধারিত হয়।