জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে এক নতুন যুগের সূচনা হলো এই সোমবার ২৩ই জুন। চিলির পাহাড়ের গা ঘেঁষে বসানো Vera C. Rubin Observatory প্রকাশ করেছে তাদের প্রথম পর্যবেক্ষণচিত্র, যা বিশ্বের বৃহত্তম ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে তোলা। মাত্র ১০ ঘণ্টার পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণেই তোলা হয়েছে এমন কিছু ছবি, যা ইতোমধ্যেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে। এতে যেমন রয়েছে কোটি কোটি তারার চিত্র, তেমনি রয়েছে নক্ষত্র জন্মের অঞ্চল এবং এক বিশাল ছায়াপথ-গুচ্ছের নিখুঁত দৃশ্য। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন “আস্ট্রো-সিনেমাটোগ্রাফির সূচনা”।
রুবিন টেলিস্কোপের LSST ক্যামেরায় তোলা প্রথম ছবির একটিতে দেখা যাচ্ছে Virgo Cluster—যেটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৫৪ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। মাত্র ১০ ঘণ্টায় তোলা এই ছবিতে ধরা পড়েছে প্রায় ১০ মিলিয়ন গ্যালাক্সি, যা রুবিনের মোট জরিপের মাত্র ০.০৫ শতাংশ।
ছবিতে একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে আমাদের মিল্কি ওয়ের নিকটবর্তী উজ্জ্বল নীল তারা, কাছের সর্পিল গ্যালাক্সি, এবং দূরবর্তী লালচে গ্যালাক্সি গ্রুপ। এর মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে রুবিন কেবল অদেখা জগৎকে দেখাচ্ছে না—একইসঙ্গে সময় ও দূরত্বের ভেতর এক বিশাল ঐক্য তৈরি করছে। এমন বিশাল বিস্তৃত ও সূক্ষ্ম গ্যালাক্সি ম্যাপিং অতীতে কোনো একক ছবিতে সম্ভব হয়নি। এই ছবির মধ্যে থাকা বিভিন্ন গ্যালাক্সি সর্ম্পকে জানা যাবে এখানে: https://skyviewer.app/guided-experiences
রুবিনের দ্বিতীয় প্রকাশিত ছবিটি নেওয়া হয়েছে ধনু (Sagittarius) অঞ্চলের দিকে, যেখানে অবস্থিত লাগুন নেবুলা (Messier 8) ও ট্রাইফিড নেবুলা (Messier 20)— আমাদের নিজস্ব ছায়াপথ মিল্কি ওয়ের নক্ষত্র জন্মের দুটি বিখ্যাত অঞ্চল।
ছবিটি তৈরি করতে ব্যবহৃত হয় ৬৭৮টি এক্সপোজার, মে মাসের ১ থেকে ৪ তারিখ মাত্র ৭ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে। চূড়ান্ত ইমেজের আকার—৮৪,০০০ × ৫১,৫০০ পিক্সেল, যা মানব ইতিহাসে অন্যতম বিস্তারিত মহাকাশচিত্র। এতে দেখা যায় হাইড্রোজেন গ্যাসের লাল আভা, নীল আলোর প্রতিফলন, এবং তরঙ্গায়িত ধূলিকণার স্তর।
রুবিন অবজারভেটরির মূল অস্ত্র হলো ৮.৪ মিটার ব্যাসের Simonyi Survey Telescope এবং LSST Camera (LSSTCam)—বিশ্বের বৃহত্তম ডিজিটাল ক্যামেরা, যার আকার একটি ছোট গাড়ির মতো এবং যার প্রতিটি ছবি আকাশের ৪৫টি পূর্ণচন্দ্রের সমান এলাকা ঢেকে ফেলে।
এই টেলিস্কোপ প্রতি তিন দিনে একবার করে পুরো দক্ষিণ আকাশ স্ক্যান করবে, এবং ১০ বছরে সংগৃহীত হবে প্রায় ৪০ বিলিয়ন মহাজাগতিক বস্তুর ‘টাইম-ল্যাপ্স’ বা চলমান ডেটাবেস। এই বিশাল জরিপ প্রজেক্টটির নাম Legacy Survey of Space and Time (LSST)।
রুবিন টেলিস্কোপের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর time-domain astrophysics—অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহাবিশ্বের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করা। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি হবে “মহাবিশ্বের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা”।
এই চলমান ছবি থেকে বিজ্ঞানীরা দেখতে পারবেন ১০ কোটি’রও বেশি পরিবর্তনশীল তারা (যারা উজ্জ্বলতা পাল্টায়), লক্ষাধিক সুপারনোভা বিস্ফোরণ, গ্রহের চলাচল বা “ট্রানজিট”, গ্রহাণুর কক্ষপথ, দূরবর্তী গ্যালাক্সির সংযোগ ও সংঘর্ষ। এই পর্যবেক্ষণগুলো মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ, ডার্ক ম্যাটার ও ডার্ক এনার্জি বোঝার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এই প্রকল্পটি পরিচালনা করছে National Science Foundation (NSF) এবং Department of Energy (DOE)-এর অংশীদারিত্বে গঠিত Rubin Observatory Project Team। অংশ নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, চিলি, ইউরোপ ও বিশ্বের আরও বহু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও মহাকাশ সংস্থা।
প্রকল্পের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দিক পরিচালনায় যুক্ত আছেন ক্যালটেক, SLAC National Accelerator Laboratory, Princeton University, University of Washington, NOIRLab-এর মতো বিশ্বসেরা গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিজ্ঞানীরা।
Rubin Observatory এর ডেটা মুক্তভাবে সবার জন্য উন্মুক্ত, এবং স্কুলের ছাত্র থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক—যেকোনো বয়সের জ্ঞানপিপাসু এতে অংশ নিতে পারে। বাংলাদেশসহ যেকোনো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী এবং গবেষকরা এই ডেটাসেট ব্যবহার করে মহাবিশ্বের নানা রহস্য উদঘাটনে কাজ করতে পারবেন।
এই ডেটা থেকে গ্রহাণু আবিষ্কার, নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ, গ্যালাক্সির গঠন অধ্যয়ন বা এমনকি মহাবিশ্বের বিস্তার নিয়ে নতুন তথ্য পাওয়া সম্ভব। ফলে বাংলাদেশসহ সব জায়গার তরুণরা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানমঞ্চে নিজেদের জায়গা করে নিতে পারবে, এবং যথাযথ দিকনির্দেশনা পেলে নিজেদের হাতেই আসতে পারে পরবর্তী বড় জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার।
রুবিন অবজারভেটরির এই প্রথম ছবিগুলো কেবল সূচনা। সামনের মাসগুলোতে LSST পুরোপুরি শুরু হবে, আর তখন প্রতিদিন মহাকাশ থেকে আসবে নতুন নতুন চিত্র ও রহস্য। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, রুবিন আমাদের এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, যা আমরা আজ কল্পনাও করতে পারছি না।