নোটিশ:

ব্লাসফেমি আইন কি রাখাল রাহাদের দমাতে পারবে?

ফারসি সালমান
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৭৭ বার দেখা হয়েছে
ব্লাসফেমি আইন,ধর্মীয় অবমাননা, ইসলামপ্রিয় জনতা, নাস্তিক, সেকুলার, আলেম-ওলামা, ইসলামিক বুদ্ধিজীবী, পশ্চিমা সভ্যতা, ইসলামবিদ্বেষ, ইসলামী ভাবধারা, প্রতিবাদ, ধর্মীয় আবেগ, জাতীয় জীবনে ইসলাম, ইসলামিক খেদমত, পাকিস্তান, পশ্চিমা আদর্শ, নাস্তিক ব্লগার, ধর্মীয় আইন, ইসলাম সম্পর্কিত অজ্ঞতা, মিডিয়া, সমাজের অর্থনীতি, মাদ্রাসা, ইসলামিক ব্যাংক, মুসলিম জনগণ, ফেসবুক, ইসলাম ধর্ম, ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা,
ছবি: এআই

ফেসবুকে ‘রাখাল রাহার প্রকাশ্যে ফাঁসি চাই’ নামে ইভেন্ট খোলা হয়েছে। আল্লাহকে নিয়ে অশালীন ফেসবুক পোস্ট দেওয়ার প্রতিবাদে সম্প্রতি সাধারণ মুসলিম জনতা তার ছবিতে জুতা মারা কর্মসূচী পালন করতে না করতেই এই ইভেন্ট খোলা হলো। ইসলামী জগতের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা মনে করছেন, যতদিন পর্যন্ত দেশে ব্লাসফেমি আইন চালু না হবে ততদিন পর্যন্ত এরকম করে মুসলিম জনতার ধর্মীয় আবেগের সুযোগ নিয়ে একের পর এক সুবিধাবাদী নাস্তিক ইসলামকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতে থাকবে।

এদেশে ইসলামকে ব্যঙ্গ করলে আলেম-ওলামা থেকে শুরু করে ইসলামপ্রিয় জনতা যে ফুঁসে ওঠে তা এই পর্যন্ত বহুবার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তারপরেও কেন কিছুদিন পর পর এমন করা হয় তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা গেছে, এর পেছনে বেশ কিছু কারণ জড়িত। প্রথমত, ইসলাম এর বিপক্ষে এখন পর্যন্ত যারা কথা বলেছে তারা নেগেটিভ মার্কেটিং এর সুবাদে দেশ ও বিদেশে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। সাধারণত পশ্চিমা দেশগুলোতে জিহাদ-আফগানিস্তান-খিলাফত ইত্যাদি বহু ইসলামিক ইস্যু নিয়ে কথা বলাকে থ্রেট হিসেবে গণ্য করা হয়, সমকামিতার বিপক্ষে, নন-বাইনারি জেন্ডার থিওরির বিপক্ষে কথা বলাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে দেখা হয়। এগুলোর বিরুদ্ধে কথা বললে অনেক সময় জেল-জুলুম-চাকরিচ্যুতি সহ নানা ধরণের হয়রানির শিকার হতে হয়। কিন্তু ইসলামের যে কোনো টপিকের বিপক্ষে কথা বলাকে তারা বাকস্বাধীনতা হিসেবে গণ্য করে থাকে। যেহেতু এদেশের নাস্তিক, বাম ও সেকুলারদের আদর্শ পশ্চিমঘেঁষা, পশ্চিমা সভ্যতার সাময়িক উৎকর্ষ দেখে তাদের চোখ ঝলসে গেছে, এই কারণে ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলার মাধ্যমে তারা দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ঘৃণার শিকার হলেও এর মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে। এভাবে দেশের বেশ কিছু নাস্তিক ব্লগার তাদের বহুল আরাধ্য সেইসব দেশগুলোতে এসাইলাম ভিসা বাগিয়ে নিয়েছে।

উপরন্তু এদেশ নব্বই-পঁচানব্বই শতাংশ মুসলিম জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত হলেও নেতৃত্ব প্রশ্নে প্রায় স্বাধীনতার পর থেকেই সেকুলারদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ, দেশের সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট ইসলামঘেঁষা হলেও, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের চাকরিগুলো সেকুলার ও পশ্চিমা আদর্শে বিশ্বাসীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তদুপরি, দেশের আলেম সমাজের ওয়াজ-মাহফিল ও মসজিদ-মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামী খেদমত এর দিকে অধিক ঝোঁকের সুযোগে বহু পূর্ব থেকেই এদেশের মিডিয়াগুলো বামঘেঁষাদের দখলে চলে গেছে। ইসলামপন্থীরা ধর্মীয় অবমাননার মতো ইস্যুকেন্দ্রিক প্রতিবাদে মুখর হলেও দীর্ঘমেয়াদে ইসলামের জন্য কাজ করার কৌশল নির্ধারণ করেননি, তারা নিজেদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরার জন্য মূলধারার মিডিয়া হাউজও প্রতিষ্ঠা করেননি। এসব কারণে সেই শুন্যস্থান নাস্তিক-সেকুলাররা দখল করে ফেলেছে। তাই দেশের রাষ্ট্রীয় বা বেসরকারি বড় বড় পদ-পদবী-পদক সবই তাদের দখলে। ইসলাম এর বিপক্ষে কথা বললে সেই শ্রেণির দৃষ্টি আকর্ষণ করা সহজ হয়, বুদ্ধিজীবি খেতাব পাওয়া যায়, এবং তাদের প্রিয়ভাজন হওয়ার দ্বারা উচ্চতর সম্মানজনক পদ-পদবী-পদক জোটে বলেও অনেকে ইসলামী ভাবধারার বিপক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান গ্রহণে প্রলুব্ধ হয়।

এর পেছনে আরেকটি জিনিস কাজ করে, সেটি হলো মানসিক হীন্মন্যতা। এদেশে ইসলাম নিয়ে কটুক্তিকারীদের সবাই যে নিজেকে নাস্তিক পরিচয়ে পরিচিত করতে চায় তা-ও নয়। কিন্তু ইসলাম বিষয়ে তাদের জ্ঞানের দৌড় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঠিত দুই-চারটি ইসলামী ঘটনা পর্যন্তই। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর চলার পথে বুড়ির কাঁটা বিছিয়ে রাখা, জনৈক সাহাবিকে নবীজির (সঃ) পাখির ছানা ধরতে নিষেধ করা, বিড়ালকে বেঁধে রাখা, কুকুরকে পানি খাওয়ানো, বিদায় হজ্বের ভাষণ এরকম দুই চারটি সিলেক্টিভ বিষয় ভাসাভাসাভাবে জেনেই তারা আলেম-ওলামার সমালোচনা করতে লেগে যায়। কিন্তু ইসলাম যে একটি সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থা, নামাজ-রোজা ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য-রাজনীতি সবকিছুতেই যে ইসলাম মানার আছে তা তারা জানেন না, অথবা জানলেও মানেন না।

কারণ ইসলামের সোনালী যুগ সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে তারা ইসলামকে শুধু নামাজ-রোজার মধ্যে সীমাবদ্ধ ভাবেন আর জাতীয় জীবনে ইসলাম চর্চার প্রসঙ্গ উঠলে ইসলামকে পশ্চাৎপদতার কারণ মনে করে ইসলামবিদ্বেষী কথা বলে ফেলেন। উপরন্তু পশ্চিমা বাকস্বাধীনতার বয়ান এমনভাবে তাদের মন মগজ আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে ধর্ম নিয়ে যাচ্ছেতাই বলতে পারাকে তারা সাহসিকতা ও প্রগতিশীলতা মনে করে। কিন্তু তারা এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম সমাজ যে উন্মাদনা প্রদর্শন করে সেটিকে আবার উগ্রতা মনে করে। অথচ তাদের প্রগতিশীলতার আইকনদের নিয়ে কটু কথা বললে তাদেরও সমরূপ উগ্রতা বের হয়ে আসে। যেমন: হিরো আলম এর বেসুরো কণ্ঠে রবীন্দ্র সংগীত গাওয়া পর্যন্ত তাদের সহ্য হয়নি, কেননা রবীন্দ্রনাথ তাদের চোখে ঈশ্বর, আর তার গান পবিত্র।

একইভাবে যে ইসলামপ্রিয় জনতার চোখে ইসলামের বিষয়-আশয় পবিত্র, এবং সর্বোপরি এসব বিষয়ে কটুক্তি হলে প্রতিবাদ করা যে ঈমানের দাবি তা তারা বুঝতে চায় না। এমনকি তারা এটাও জানে না যে ইসলাম নিয়ে যাচ্ছেতাই মন্তব্য করলে ঈমান চলে যায়। তাদেরকে এটা বোঝাতে গেলে তারা পাল্টা বলে যে অন্তরের মালিক আল্লাহ। অর্থাৎ, তারা মনে প্রাণে অমুসলিম  হতে চায় না হয়ত, কিন্তু তাদের কথা কাজ তাদেরকে ঈমানের গন্ডি থেকে বের করে কখন যে কুফরের গন্ডিতে ঠেলে দেয় তা নিয়ে তারা বেখবর।

কাজেই দেখা গেল, ইসলাম নিয়ে কটুক্তির মূল কারণ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা, পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা ও নীতিনৈতিকতাবোধের কুপ্রভাব, যশ-খ্যাতি ও পশ্চিমা ভিসা। এর বাইরে কারো কারো ভেতরে জন্ম নেওয়া প্রচন্ড ইসলামবিদ্বেষ ও পশ্চিমাপ্রীতিও কাজ করে থাকতে পারে।

প্রশ্ন হলো, এগুলোর প্রতিকার কী? প্রথমত এই ধরণের কথাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে আইনি বিধান লাগবে। কারণ সেকুলাররা আল্লাহকে ভয় না করলেও আদালতকে ঠিকই ভয় করে। এই কারণে আইনি কঠোরতা আরোপ করলে এসব অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এই আইনটাই হচ্ছে ব্লাসফেমি আইন। যেটি ধর্মীয় বিষয়ে কটুক্তি করে ধর্মপালনকারীদের মর্মপীড়া বাড়ানো ও অনাকাঙ্খিত  দাঙা-হাঙামা-বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে সহায়তা করে। বহুদিন ধরে এদেশের সাধারণ আলেম-ওলামা ও ইসলামপ্রিয় জনতা ব্লাসফেমি আইনের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে জনতার এই সম্মিলিত দাবির প্রতি কর্ণপাত করছে না রাষ্ট্র । অথচ পাকিস্তানে ১৯২৭ সাল থেকেই হেট স্পিচ বিরোধী ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এবং উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৭ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইনের অধীনে কমপক্ষে ১,৮৫৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। যতদিন না ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন হবে ততদিন দেশের মানুষ ধর্ম অবমাননাকারীদের শাস্তি দিতে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে প্রবণতা দেখাবে।

এবার ইসলামপ্রিয় জনতার প্রতিও এই অধমের কিছু বলার আছে। শুধু ইস্যুকেন্দ্রিক প্রতিবাদ না করে দীর্ঘমেয়াদে দাওয়াত জারি রাখা প্রয়োজন। যেমন: ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে ফেস দ্য পিপলে মাওলানা এনায়েতুল্লাহ আব্বাসির যে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল, তাতে এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী ডা: জাফরুল্লাহর উপর এতটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তিনি রীতিমতো আমপারা শিখতে আরম্ভ করেছিলেন। এরপরে যে জিনিসটি দরকার সেটি হচ্ছে আলেমদের মধ্যে জনসম্পৃক্ততা। শায়খ আহমাদুল্লাহ, আব্দুল হাই মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ প্রমুখ আলেমরা ওয়াজ-মাহফিলের বাইরে এসে যে ধরণের খেদমত করছেন তাতে সামাজিকভাবে ইসলাম শক্তিশালী হচ্ছে। আরিফ আজাদ, শামসুল আরেফিন শক্তি প্রমুখ অ্যাক্টিভিস্টদের মেহনতে মানুষ ইসলামের বিধি-বিধানের অন্তর্নিহিত লজিক-হেকমত বুঝতে পারছে, ইসলাম নিয়ে উটকো মন্তব্য কমে আসছে। এর পাশাপাশি এখন যে জিনিসটি লাগবে সেটি হলো মিডিয়া। ইসলামপ্রিয় জনতার পক্ষে কথা বলবে এমন মিডিয়াগুলো সাধারণত মান নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় এখনও প্রথম আলো-ডেইলি স্টারের হেজিমনি চলছে। ইনকিলাব, সংগ্রাম, নয়া দিগন্ত প্রভৃতি মিডিয়া মুসলিম জনগোষ্ঠীর আকাঙ্খা পূর্ণ করতে পারেনি। এগুলো প্রথম আলো-ডেইলি স্টার এর তুলনায় জনগণের চোখে সস্তা ও কম গ্রাভিটি সম্পন্ন। সাংবাদিকতার কলাকৌশল প্রয়োগে দুর্বলতা, মানুষের অন্তর্জগত নিয়ন্ত্রণ করে এমন কাজে সম্পৃক্ততার অভাব, এবং মোটাদাগে প্রথম আলো-ডেইলি স্টারদের অনুকরণ করে চলার প্রবণতার কারণে নিজস্ব স্ট্যান্ডার্ড গড়ে না ওঠা এর প্রধান কারণ।

তাই মুসলিমদের মাদ্রাসা-খানকা, মসজিদ-মক্তব, ওয়াজ-মাহফিল ছাড়াও মিডিয়াকেন্দ্রিক মেহনত যেমন: সংবাদপত্র-পোর্টাল, আইপি টিভি, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুক পেজ এগুলোর দিকে বেশি করে ঝুঁকতে হবে। কেবল আতর-মেসওয়াক-টুপি আর হজ্ব-ওমরা ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসাই নয়, সমাজের সকল ধরণের হালাল পেশার নিয়ন্ত্রণ নিতে হবে। কেবল মাদ্রাসা-এতিমখানা প্রতিষ্ঠাই নয়, স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল-বিশ্ববিদ্যালয়-ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠাতেও এগিয়ে আসতে হবে। ইমামতি এমন কোনো ব্যস্ততম পেশা নয় যেটি করতে গেলে অন্য কোনো কাজ করা যায় না (কারণ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ শুধু ইমাম পড়েন না, তার পেছনে মুসল্লিরাও পড়েন)। ইমাম আবু হানিফা এত গবেষণা করতেন রেশমের ব্যবসা করেই, আমাদের ইমামরা নিশ্চয় তার চেয়ে বেশি ব্যস্ত নন! কাজেই ইমামতিকে পেশা হিসেবে না নিয়ে ইমামদের সমাজের অন্য কোনো পেশায় সম্পৃক্ত হওয়া উচিত বলে মনে করি। জনগণের দান ও হাদিয়াকেন্দ্রিক জীবন ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে  আত্মোপার্জনমূলক জীবনের দিকে আসতে হবে। সমাজের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে জিডিপিতে অবদান রাখতে পারলে তবেই সেকুলারদের মুখে ঝামা ঘষে দেওয়া যাবে। এভাবে করতে থাকলে অচীরেই একদিন ইসলাম নিয়ে হীন্মন্যতার বদলে শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের প্রতি তলব সৃষ্টি হবে ইনশাআল্লাহ!

  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর সর্বশেষ নিউজ পড়তে ক্লিক করুন: সর্বশেষ
  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর ফেসবুক পেজটি ফলো করুন: dailysabasbd

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT