মুসলিম মেজোটেরিয়ান দেশে ডেমোক্রেসি সাধারণত লিবারেল আদর্শ ধারণ করতে ব্যর্থ হয়। এজন্য মুসলিম মেজোটেরিয়ান কান্ট্রির ডেমোক্রেসিকে বৈদিশিক শক্তি এবং আধুনিক লিবারেল ধ্যান ধারণাতে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা মুসলিম দেশের ডেমোক্রেসিকে মানতে নারাজ । যতক্ষণ পর্যন্ত নারী স্বাধীনতা, ধর্ম বিকৃতির স্বাধীনতা, লিঙ্গ পরিচয়ের স্বাধীনতা, যৌন স্বাধীনতা সহ বিভিন্ন আধুনিক লিবারেল পলিসিকে কোন দেশের মুসলিমরা মেজোটেরিয়ান হিসেবে মানতে সক্ষম হবে না ততদিন পর্যন্ত সেখানে ডেমোক্রেসি বলতে যেটাই থাকুক তা পাশ্চত্যের নিকট ডেমোক্রেসি হিসেবে সাব্যস্ত হবে না।
হাসিনার পতনের পর খুব সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে মুসলিম মেজোটেরিয়ান পলিসি ব্যাক করার। হয়তবা এই মেজোটিরিয়ানরা সরাসরি ইসলামি শাসন চায় না। কিন্ত এই সমাজের মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে না চাইতেও তাদের আচার আচরণে ধর্মের প্রভাব অনেক সময়ই স্পষ্ট হয়ে উঠে। এবং এই স্পষ্ট হয়ে উঠাটা অঞ্চলভেদে ভিন্ন হয়ে দেখা দেয়। যেমন: ধানমন্ডির লেকে একজন মেয়ের পক্ষে যতটা সহজে সকাল বেলা হাফপ্যান্ট পরে জগিং করাটা সহজ ঠিক এর বিপরীতে গ্রামে একজন মেয়ের পক্ষে হাফপ্যান্ট পরে জগিং করা তো দূরের কথা সেখানে একজন মেয়ে স্বাভাবিক ট্রাডিশনাল ড্রেস ত্যাগ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমা লিবারেল দুনিয়া সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নিন্দা এবং সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখে যদিও মেজোটিরিয়ান পিপল এর পক্ষে থাকে। কেননা, লিবারেল পলিসি অনুসারে একজন নারী পুরুষের মধ্যকার অধিকার সম্পন্ন সমান থাকতে হবে। পুরুষেরা হাফ প্যান্ট পরে ফুটবল খেলতে পারলে মহিলাদেরকেও ঠিক একইভাবে হাফপ্যান্ট পরে খেলার সুযোগ দিতে হবে। এখানে কোন ঢাকা ঢাকির প্রশ্ন আসবে না।
এজন্য নিউ ইয়র্ক টাইমস বাংলাদেশে উগ্রবাদের আগমন নিয়ে রিসেন্ট যে আর্টিকেলটি লিখেছে সেখানে এগুলো এতটা ডিটেইলস করে তুলে ধরেছে। একবার মেয়েদেরকে ফুটবল খেলতে দেওয়া হল না তারপরে আবার ফুটবল খেলতে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল কিন্ত মেয়েদেরকে তাদের শর্টসের নিচে মোজা (দীর্ঘ মোজা) সাবধানতা স্বরূপ পরতে হয়। অর্থাৎ যতটুকু শরীর ঢেকে খেলানো সম্ভব। নিউ ইয়র্ক টাইমস এই রিপোর্টের ডিটেইলস দিয়ে তাদের ভাষ্যানুসারে গণতান্ত্রিক ব্যর্থতার এক আগাম ভবিষ্যত তুলে ধরেছে। এমনকি নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের রিপোর্টে কথিত ক্রিটিক্সদের আলাপ তুলে ধরেছে যে ক্রিটিকসরা বলছেন,
‘যে ৮৪ বছর বয়সী নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চরমপন্থী শক্তির বিরুদ্ধে যথেষ্ট কঠোর অবস্থান নেয়নি। তারা মিস্টার ইউনুসকে নরম মনোভাবাপন্ন বলে অভিযুক্ত করছেন, যিনি গণতান্ত্রিক সংস্কারের জটিলতায় হারিয়ে গেছেন, সংঘাত এড়িয়ে চলতে চান এবং যখন চরমপন্থীরা আরও বেশি জনসমর্থন অর্জন করছে, তখন তিনি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন’।
অর্থাৎ ইউনুস সরকার কেন এই ইসলামভাবাপন্ন জনগোষ্ঠীর উপর ক্রাক ডাউন চালাচ্ছে না এটা এই সমালোচকদের প্রশ্ন। যদি যথেষ্ট পরিমাণ ক্রাক ডাউন চালানো হত তাহলে ইসলামিস্টরা এতটা আস্ফালন দেখাতে পারত না। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে নিউ ইয়র্ক টাইমস ইসলামিস্টদের বিরুদ্ধে কতৃত্ববাদী হওয়ার আহবান জানাচ্ছে শুধুমাত্র এই কারণে যে তারা গণতন্ত্রের লিবারেল পলিসির সাথে নিজেকে মানিয়ে উঠতে পারছে না।
কিন্ত আমরা বিগত সরকারের রাষ্ট্রীয় ক্রাক ডাউন হতে শুরু করে বিভিন্ন দমন-পীড়ন এবং গুমের কেসগুলো যদি ঘাটাঘাটি করি তাহলে এটা স্পষ্ট হয় যে ইসলামিস্টদের উপর হাসিনা সরকার মূলত কতৃত্ববাদী আচরণ করার কারণেই ইসলামিস্টদের পক্ষে নিজদের সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়াবার সুযোগ হয় নি। কেননা তারা যতবারই নানা দাবি নিয়ে দাড়িয়েছিল ততবারই তাদেরকে গণহত্যার সম্মখীন হতে হয়েছে। তাই সমালোচকেরা যখন এ কথা বলছেন যে ইউনুস সরকার যথেষ্ট বলপ্রয়োগ করছে না। তখন তারা মূলত ইউনুস সরকারকে হাসিনার মত কতৃত্ববাদী হওয়ারই আহবান জানাচ্ছে। ফেইসবুকে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই রিপোর্টটিকে যারা পজিটিভলি শেয়ার দিচ্ছেন তাদের অ্যাক্টিভিজম দেখে বুঝতে পারছি এই সমালোচকদের বড় একটা অংশই পেশাদার সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মী এবং সাংস্কৃতিক কর্মী। অর্থাৎ তারা হাসিনার কতৃত্ববাদী পলিসিকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে শুধুমাত্র ইসলামিস্টদেরকে দমন করার জন্য। হিটলার যেমন কমিউনিস্টদেরকে দমন করার জন্য জার্মানির সব নেতাদেরকে একত্র করে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল এই স্মার্ট ড্যুডসরাও ইসলামিস্টদেরকে দমন করার জন্য নতুন কোন বন্দোবস্ত চাচ্ছে যাকে তারা গণতন্ত্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে নতুন করে পরিচয় করাবে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস আমি নিয়মিত পড়ি। বিশেষ করে বাংলাদেশ নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট খুব একটা মিস করিনা। নিউ ইয়র্ক টাইমস হাসিনার আমলে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি বলতে মূলত অন্যান্য সেক্যুলার দলের উপর ক্রাক ডাউনকেই বুঝিয়েছে। ইসলামিস্টদের উপর নয়। বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী এবং হাসিনার সমালোচকদের বড় একটা অংশই ইসলামিস্টদের উপস্থিতিকে নিজেদের জন্য অস্বস্তির কারণ মনে করেছে। কেননা ইসলামিস্টদের দাবি দাওয়া একটাও আধুনিক গণতন্ত্রের পলিসিতে উত্তীর্ণ হতে পারবে না। লিবারেল ডেমোক্রেটিয়ান পলিসি মেকাররা আমেরিকা কিংবা ইউরোপের রাইট উইংদের সমালোচনা করে এবং যদিও তারা মনে করে তাদের গণতন্ত্র গণতন্ত্র না। কিন্ত তারা মনে করে এরা অন্তত মুসলিমদের থেকে বেটার। তারা অন্তত নারীদেরকে ছোট খাট পোষাক পরার স্বাধীনতাতে বিশ্বাসী। ফক্স নিউজের মহিলা রিপোর্টারদের বেশ ভূষা দেখলেই বিষয়টা বুঝবেন। গত দুদিন আগেই নিউ ইয়র্ক টাইমস এরকম এক রাইট উইং কনজারভেটিভ মহিলাদের লাইফ স্টাইল ম্যাগাজিন নিয়ে রিপোর্ট করে। যেখানে বিকিনি মডেলদের ছবি ছাপানো হয়, নারীদেরকে নারীত্বের সৌন্দর্যের ছবি ছাপানো হয়, সেক্স টিপ দেওয়া হয়। সবই হয় শুধু ফেমিনিজমটা হয় না। কাইন্ডা পজিটিভ রিভিউ। কিন্ত মুসলিমরা তো এথেকেও খারাপ ! কেননা তারাতো নারীদের কোম সৌন্দর্য প্রদর্শনেরই পক্ষপাতী না। এজন্য মুসলিমদের ডেমোক্রেসিকে ডেমোক্রেসি মানা সম্ভব হয়ে উঠে না।
নিউ ইয়র্ক টাইমস হাসিনা বিরোধী রিপোর্ট করেছে সত্য। তা অস্বীকার করছি না। কিন্ত যখন তারা দেখল হাসিনার পরে যে শূন্য স্থানের তৈরি হয়েছে সেখানে ইসলামিস্ট এবং মেজোটিরিয়ান মুসলিমদের দাড়িয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা রয়েছে তাই তারা যেন দাড়াতে না পারে এজন্য তাদেরকে যতটা সম্ভব দানব বানাতে হবে। এটা নিউ ইয়র্ক টাইমসের ডে ওয়ান পলিসি। এজন্য সাতই আগস্টে নিউ ইয়র্ক টাইমস রিপাবলিক বাংলা ক্যাটাগরির একটি শিরোনাম দিয়ে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে মিথ্যে একটা রিপোর্ট ছাপায়। রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘Hindus in Bangladesh face revenge Attacks After Prime Minister’s Exit’ . শিরোনামটা খেয়াল করুন। শিরোনাম দেখে মনে হবে প্রথম আলো-র আমেরিকান ভার্সন। প্রধান মন্ত্রী চলে গিয়েছে কিংবা বের হয়ে গিয়েছে কিন্ত পালিয়ে যায় নি। স্বৈরাচার শব্দটা পর্যন্ত লিখেনি। লিখেছে প্রাইম মিনিস্টার। এই রিপোর্ট যারা করেছে তারাই টাইমসের সাম্প্রতিক রিপোর্টটি করে। মুসলিম মেজোটিরিয়ান কান্ট্রিতে মাইনোরিটির উপর অত্যাচার একটা হট টপিকস। এরকম রিপোর্ট মুসলিমদেরকে দমন করার জন্য শক্তিশালী ন্যারেটিভ তৈরি করতে সাহায্য করে। রিপোর্টে যতগুলো তথ্য তুলে ধরা হয়েছে এর বেশিরভাগই ভুয়ো এবং ভুল তথ্য। প্রিয়ন্তি চ্যাটার্জি নামক যে তরুনীর বক্তব্য এখানে সংখ্যালঘু হত্যার ব্যাপারে বক্তব্য আনা হয়েছে তা স্পষ্ট মিসলিডিং। তার বাবাকে হামলা করা হয় জমিজমা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে। কিন্ত এখানে বিবৃতিতে স্পষ্ট করে Muslims attacked বলে মুসলিমদেরকে ডেমোনাইজ বানানোর চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীতে প্রথম আলো, বাংলা নিউজ সহ অনেক রিপোর্টে এ নিয়ে বিস্তারিত আসে যে এটা একটা নিখাঁদ জমি জমা সংক্রান্ত ঝামেলা। এখানে হিন্দু মুসলিম কোন ইস্যু নেই। নিউ ইয়র্ক টাইমস আরেকটা ভুয়ো ইনফরমেশন শেয়ার করে যে চিটাগাংসহ কয়েকটা জেলাতে মন্দির হামলার কথা উল্লেখ করা হয়। কিন্ত জাতীয় পত্রিকা আজকের পত্রিকা সহ আরো কিছু পত্রিকা সরেজমিনে রিপোর্ট করে যে এরকম মন্দির হামলার কোন বাস্তবতার প্রমাণ মেলেনি। এমনমি OHCHR তাদের রিপোর্টে একটি মন্দির হামলার স্পষ্ট করে স্থানসহ উল্লেখ করে কিন্ত পরবর্তীতে বের হয়ে আসে যে এটাও জমি জমা সংক্রান্ত সমস্যার কারণে ঘটেছে।
নিউ ইয়র্ক টাইমস এরপর পনেরো আগস্টে ধানমন্ডি বত্রিশ নাম্বারের সামনে ছাত্র জনতার উপস্থিতিকেও মব হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। ডেভিড বার্গম্যানও একই কাজ করে। মুজিব মাশাল ছাত্র জনতার সেদিনের সচেতন উপস্থিতিকে তার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে It’s Complete mob rule হিসেবে দাবি করে। এতটুকু হলেও হত সে বলে গতকালকের মজলুমরা আজকে জালেম !
নিউ ইয়র্ক টাইমস যে রিপোর্ট করে সেই রিপোর্টের তারা আর কোন ফলো আপ রিপোর্ট তারা করে না। এটা মিডিয়া কালচারে তাদের গ্যাংস্টার সিম্পটম স্পষ্ট করে তুলে। অর্থাত যা বলছি তো বলছিই। তা ভুল হোক কিংবা সঠিক ঐ কথা নিয়ে আর দ্বিতীয়বার আলাপ তোলার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের মুসলিমরা কাদিয়ানীদেরকে আদৌ মুসলিম মনে করে কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর তারা জানার চেষ্টা করবে না কিন্ত তারা ঠিকই ইসলামের বিকৃতি করে নতুন ধর্ম কাদিয়ানীদের নিজস্ব দাবি অনুসারে তাদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় করানোর জন্য উঠেপড়ে লাগবে অন্যদিকে ফুটবল খেলোয়ার মেয়েদেরকে হাটু ঢাকাটাকে তারা গণতন্ত্রের অধীনে মেনে নিতে নারাজ। কত সহজে হিন্দুদেরকে ভিক্টিম বানিয়ে সাত তারিখেই একটা রিপোর্ট করে ফেলল। কিন্ত এরপর যে এ দেশের মুসলিমেরাই মন্দির পাহারা দিল তাও আবার হার্ড লাইনের ইসলামিস্টরা তা নিয়ে কিন্ত কোন ফলো আপ রিপোর্ট টাইমস আর টাইমসের পান্ডাদেরকে ছাপাতে দেখবেন না। যেহেতু এ দেশের মুসলিমেরা তাদের লিবারেল পলিসি যা এই লেখার শুরুতে উল্লেখ করেছি সেগুলো মেনে নিচ্ছে না তাই তারা মন্দির পাহারা দিক আর যাই পাহারা দিক তারা উগ্রই। আমাদের ধর্মকে বুঝতে হবে নিউ ইয়র্ক টাইমস আর কথিত মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের বরাতে।
লেখক: সাওয়াবুল্লাহ, পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট