খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই তরুণ শিক্ষার্থী নূর মোহাম্মদ অনিক ও মোজাহিদুল ইসলামের জীবনে হঠাৎ করেই নেমে এসেছিল এক অন্ধকার অধ্যায়। ১৭ দিন পর্যন্ত তাদের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবাই যেন হতভম্ব। কিন্তু এর পেছনে ছিল রাষ্ট্রযন্ত্রের এক অমানবিক কৌশল, এক নির্মম বাস্তবতা—যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীকেও জঙ্গি বলে চালিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হয়।
তাদের চোখ-মুখ বেঁধে, পেছনে হাত বেঁধে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়। আর তারপর শুরু হয় রাষ্ট্রীয় ‘জঙ্গি নাটক’। মিথ্যা মামলার পাহাড় তৈরি করে দিনের পর দিন চলে নির্যাতনের উৎসব। অথচ, তারা কেউ সন্ত্রাসী ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন স্বপ্নবান তরুণ, যাদের চোখে ছিল ভবিষ্যতের আশাবাদ। সেই স্বপ্নই গুঁড়িয়ে দেয় রাষ্ট্রের পেশিশক্তি।
পাঁচ বছর ছয় মাস পর শুরু হয় সত্যের উন্মোচন। বিভিন্ন তদন্তে বেরিয়ে আসে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের ভয়াবহ চিত্র—অন্যায়ভাবে গুম, অমানবিক নির্যাতন, এবং সাজানো মামলার নেপথ্য কাহিনী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর তাদের রাখা হয় অজ্ঞাত এক স্থানে। সেখানেই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে বাধ্য করা হয় স্বীকারোক্তি দিতে—তারা নাকি কোনো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীর সদস্য। এসব নাটকের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবিরোধী সাফল্য দেখানো।
এই ঘটনায় আরও চমকে ওঠার মতো তথ্য হলো—বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলে না, বরং নির্বিকার ভুমিকা পালন করে। বরং ছাত্রদের তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের একাংশের ভূমিকা নিয়ে উঠেছে নানা প্রশ্ন। তৎকালীন বঙ্গবন্ধু হলের প্রভোস্ট ড. শামীম আহসান হলের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে অনিককে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন এলাকায় নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেন। অনিক ও মোজাহিদের অপরাধ ছিলো তারা ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখি করতো। তারা জানায়, গুম থাকাকালীন পুলিশ কর্মকর্তারা তাকে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের নির্মম পরিণতির দিকে ইঙ্গিত করে প্রাণনাশের হুমকি দেন। উল্লেখ্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ভিসি ফায়েকউজ্জামানের বাড়ি গোপালগঞ্জ। তৎকালীন স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের সুনজর পেতে তিনি এই “জঙ্গি নাটক” মঞ্চস্থ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে হাত মেলান।
শুধু এই দুই শিক্ষার্থীই নয়—দেশব্যাপী বহু তরুণ একই কায়দায় গুম, মিথ্যা মামলা ও কারাবরণের শিকার হয়েছেন। তাঁদের কারও ভাগ্যে ফিরেছে বেকসুর খালাস, কেউ আজও নিখোঁজ। এইভাবে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার নামে গড়ে ওঠা এক নির্মম বাস্তবতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো হয়ে উঠছে তরুণদের জন্য আতঙ্কের উৎস। সাবেক মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার নামে আজ মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশই বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপরাধ তরুণদের জঙ্গি বানিয়ে রাষ্ট্র তার নিজস্ব ‘সফলতা’র গল্প বানায়।”
এই দুই শিক্ষার্থীর আজকের জীবন যুদ্ধ যেন রাষ্ট্রীয় অবিচারের এক দলিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে আদালত পর্যন্ত তাঁদের প্রতিটি ধাপেই ছিল শুধুই যন্ত্রণা, অপমান, এবং অবিচার। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই দুই শিক্ষার্থী ৫.৫ বছর যাবত কারাবাস ভোগ করেন। অনিক ও মোজাহিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. রেজাউল করিম অনুরোধ করেন এবং তাদের শিক্ষাজীবন সম্পন্ন করতে যাবতীয় পদক্ষেপ গ্রহণে আশ্বস্ত করেন।