ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর ও ধারাবাহিক আক্রমণে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে গাজা উপত্যকা। মঙ্গলবার নতুন করে চালানো হামলায় অন্তত ১০৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে গাজার স্বাস্থ্য বিভাগ। এরই মাঝে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছেন—ইসরায়েল ৬০ দিনের একটি যুদ্ধবিরতির “শর্তাবলী” মেনে নিতে রাজি হয়েছে। ট্রুথ সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মে তিনি লেখেন, আমেরিকা উভয় পক্ষের সাথে এই যুদ্ধ থামাতে কাজ করছে এবং হামাসকে এতে সম্মত হওয়ার আহ্বান জানায়।
কিন্তু এসব কূটনৈতিক ঘোষণার মাঝেও বাস্তবতা ভিন্ন। গাজার উত্তরে ও দক্ষিণে ইসরায়েলি হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে অসংখ্য বাড়িঘর। মানুষ দিগ্বিদিক পালাচ্ছে, আর ভবিষ্যতের আশঙ্কায় কাঁপছে। একটি নতুন স্থল অভিযানের ভয় আরও প্রকট হয়ে উঠছে, বিশেষ করে যখন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওয়াশিংটন সফর ঘনিয়ে এসেছে।
সবচেয়ে করুণ চিত্র উঠে এসেছে মানবিক ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রগুলোতে। গাজা হিউম্যানিট্যারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF)-এর পরিচালনায় ত্রাণকেন্দ্রগুলোর সামনে অপেক্ষায় থাকা ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের উপর গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১৬ জনকে। বিতর্কিত এই ফাউন্ডেশনটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পরিচালিত হলেও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, এখানে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ভঙ্গ করা হচ্ছে। গত মে মাস থেকে GHF-এর আশেপাশে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬০০ জন। ১৭০টিরও বেশি আন্তর্জাতিক সংস্থা এই কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছে। সংস্থাগুলো যৌথ এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “গাজার মানুষ যেন এক অসম্ভব দ্বন্দের মুখে—ক্ষুধায় মারা যাওয়া নাকি খাবারের জন্য মরিয়া হয়ে দখলদার ইসরায়েলের গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া।” GHF-এর ভূমিকা মানুষকে বাঁচানোর বদলে অস্ত্র ও অনাহারের জালে আটকে ফেলেছে।
উপত্যকার উত্তরে, যেখানে জোরপূর্বক উচ্ছেদ চলছে, সেখানেও প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। একটি কোয়াডকপ্টার ড্রোন একত্রিত মানুষের উপর হামলা চালিয়ে পাঁচজনকে হত্যা করেছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার ৮২ শতাংশ এলাকা এখন হয় ইসরায়েলের সামরিক নিয়ন্ত্রণে অথবা উচ্ছেদের হুমকির মধ্যে।
গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকার ইসমাইল বলেন, “আমরা রাস্তার পাশে তাঁবু ফেলেছি, কারণ আশ্রয়ের জন্য কোনও জমি নেই। রাতভর ট্যাঙ্ক আর বোমার আওয়াজে ঘুমানো যায় না।”
খান ইউনিস ও আল-মাওয়াসি এলাকাতেও ভয়াবহ হামলায় বহু ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে শিশু, বৃদ্ধ, নারী। বাস্তুচ্যুত শিবির ও স্কুলগুলোতেও হামলা অব্যাহত, যেখানে নিরাপত্তা খোঁজার কথা, সেখানেই মৃত্যু হানা দিচ্ছে। হাসপাতালগুলো কর্মী ও জ্বালানির অভাবে কার্যত অচল। আল-শিফা হাসপাতাল, এক সময়ের প্রধান স্বাস্থ্যকেন্দ্র, এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
ইসরায়েলি বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ১৪০টির বেশি হামলা চালিয়েছে এবং প্রত্যেকটি আক্রমণই “সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য করে” বলে দাবি করেছে। অথচ বাস্তবতা বলছে, নিহতদের মধ্যে আছে অসংখ্য শিশু ও অনাহারে থাকা খাদ্যপ্রার্থী।
এমন এক সংকটাপন্ন সময়েই ট্রাম্প বলছেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত। কিন্তু হামাস জানিয়েছে, তারা এমন কোনও চুক্তিতে রাজি নয় যেখানে গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার ও যুদ্ধের স্থায়ী অবসান নিশ্চিত না করা হয়। অক্টোবর ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ৫৬,০০০-এরও বেশি ফিলিস্তিনি।
হামাসের সিনিয়র নেতা সামি আবু জুহরি মন্তব্য করেন, “মার্কিন প্রশাসনের উচিত গাজার প্রতি তাদের নিষ্ঠুরতার দায় স্বীকার করে যুদ্ধ শেষের ঘোষণা দেওয়া।” এদিকে কাতার নতুন একটি প্রস্তাব ইসরায়েল ও হামাসের কাছে পাঠিয়েছে যার মধ্যে রয়েছে ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি ও বন্দিমুক্তি।