ইরান থেকে আফগান শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর নির্মম ঘটনা দিন দিন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। দেশটিতে অবস্থান করা আফগান নাগরিকদের বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসা থাকা সত্ত্বেও ইরানি পুলিশ তাদের ধরে ধরে জোরপূর্বক সীমান্তে পাঠিয়ে দিচ্ছে। ফেরত আসা শরণার্থীদের দাবি, তাদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হচ্ছে। ইরানি পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসন শুধু গ্রেফতার করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তাদের অর্থ, মোবাইল, গাড়ি, আসবাবপত্র, বাড়ি ভাড়ার আমানতও রেখে দিয়েছে।
ফেরত আসা শরণার্থীদের অভিযোগ, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ইরানে আফগানদের বিরুদ্ধে একপ্রকার সামাজিক অবরোধ চালানো হচ্ছে। দোকান, বাজার, বেকারি থেকে শুরু করে কোথাও তাদেরকে কিছু বিক্রি করা হচ্ছে না। এমনকি আফগানদের কাছে রুটি বিক্রি না করতে দোকানিদের মৌখিক নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। সাইয়েদ আহমাদ সাদেক নামে এক ব্যক্তি জানান, তিনি একটি বেকারি থেকে রুটি নিতে গেলে দোকানি জানায়, পুলিশের নির্দেশ — আফগানদের কিছু বিক্রি করা যাবে না। একইভাবে দোকানপাটেও কেনাবেচা বন্ধ করা হয়েছে। তিনি আরো জানান, ১০ লাখ তুমান দিয়ে বাসাভাড়া চুক্তি করেছিলেন। কিন্তু বাড়িওয়ালা পুলিশি হুমকির মুখে তাদের বের করে দেয়।
একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন আবদুল্লাহ নামে আরেক ফেরত আসা আফগান। তিনি বলেন, সারা জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে ইরানে কাটিয়েছেন। তাদের গাড়ি ছিল, টাকা ছিল — সব রেখে দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এমনকি পরিবারের জমানো টাকা, ব্যবসার বিনিয়োগও লুটে নেওয়া হয়েছে। আবদুর রউফ নামে অপর একজন জানান, তাকে গুপ্তচর সন্দেহে ফোন কেড়ে নেওয়া হয়। সঞ্চিত অর্থ ছিনিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি সীমান্তে পৌছে পৌরসভার নামে বাড়তি অর্থ আদায় করা হয়েছে।
শুধু ব্যক্তিগত অর্থসম্পত্তি নয়, বহু আফগান জানাচ্ছেন যে, তারা কোটি কোটি তুমান ভাড়ার আমানত, আসবাবপত্র, গৃহস্থালির জিনিসপত্র রেখে আসতে বাধ্য হয়েছেন। বাড়িওয়ালারা ফোন রিসিভ করছে না। সরকারি কোনো দপ্তরও তাদের কথার জবাব দিচ্ছে না। এসমাতুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি বলেন, তাদের পরিবার দীর্ঘ দশ বছর ধরে ইরানে অবস্থান করেছে। প্রতি বছর ৫০০ থেকে ৭০০ লাখ তুমান ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে। কিন্তু ফেরার সময় বাড়িওয়ালা বা প্রশাসন কেউ কোনো অর্থ ফেরত দেয়নি।
আরেক ভুক্তভোগী ফারদিন জানান, পরিশ্রম করে গড়ে তোলা সংসার, বাড়ি, দোকান, গাড়ি, সবকিছু ফেলে খালি হাতে ফিরে এসেছেন। বাড়িওয়ালা টাকা পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে আদৌ তা হবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় রয়েছে। একই অভিযোগ আমির মোহাম্মদেরও। তিনি জানান, তার ২৮০ লাখ তুমান এবং সমস্ত আসবাবপত্র রেখে আসতে হয়েছে। বাড়িওয়ালার সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। তার ভাষায়, দুই দিনের ব্যবধানে ২৮০ লাখ তুমান নেয় বাড়িওয়ালা। এখন ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও ৫০ লাখও ফেরত দেয়নি। অথচ বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা, সনদ থাকা সত্ত্বেও তাকে পরিবারসহ জোর করে ফেরত পাঠানো হয়।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত নারী ও শিশুরা। পুরুষ অভিভাবকদের আটক রেখে, নারীদের সন্তানদের নিয়ে পথে নামতে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেক নারী জানিয়েছেন, ইরানে বসবাসের শেষ কয়েক সপ্তাহ তারা পুলিশের লাগাতার হয়রানি, গ্রেফতার এবং বাড়িঘর থেকে বের করে দেওয়ার ঘটনার শিকার হয়েছেন। ১৭ বছর ইরানে বসবাসের পর ফেরত আসা বিবি গুল জানালেন, তার দুই ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ, নাতি-নাতনি নিয়ে এখন পথের মানুষ। তার ভাষায়, এখন তার কারো কোনো খোঁজ নেই, কোনো অভিভাবক নেই।
পাঁচ বছর ইরানে থেকে ফেরত আসা ফারিদা জানান, তাদের পরিবারের কোনো ঘরবাড়ি নেই। তারা সরকারের কাছে আশ্রয়ের দাবি জানাচ্ছেন। ২৫ বছর ধরে ইরানে থাকা জাহরা নামের এক নারী জানান, তার ছেলেমেয়েরা সেখানেই জন্মেছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস, খাদ্যের নিশ্চয়তা ছিল। এখন তিন দিন ধরে হেঁটে সীমান্তে এসে পৌঁছেছেন। তার পরিবারের পুরুষ সদস্যরা এখনও ইরানে আটক। তাদের অবস্থানও জানেন না তিনি।
শরণার্থী অধিকারকর্মী সাইয়েদ আশরাফ সাদাত বলেন, ইরানে অবস্থানরত আফগানদের বাড়িভাড়া, ব্যাংকের টাকা এবং অন্যান্য দেনাপাওনার কোনো নিষ্পত্তি না করেই জোর করে দেশছাড়া করা হচ্ছে। এটা একেবারেই অমানবিক ও অবিচার। অবিলম্বে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
ইরান থেকে ফেরত আসা শরণার্থীদের মুখে এখন একটাই কথা — সব হারিয়ে শুধু প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা। সীমান্তের ইসলাম কালা ও হেরাত চৌকিতে কান্না, আহাজারি আর মানবিক ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে আফগান শরণার্থীদের এই ফেরার যাত্রা। কে কোথায় আছে, কার হাতে কী আছে, কিছুই জানে না কেউ। শুধু জীবনটা নিয়ে বেঁচে ফিরেছে। এখন নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই।