নোটিশ:

বাঙালির বই না কিনে সৌজন্য কপি চাওয়ার নেপথ্যে

তাসরুজ্জামান বাবু
  • আপডেট সময় রবিবার, ২ মার্চ, ২০২৫
  • ৮০ বার দেখা হয়েছে
নতুন বই বের করে সৌজন্য সংখ্যা চাওয়ার অত্যাচারে লেখকের মাথায় হাত
নতুন বই বের করে সৌজন্য সংখ্যা চাওয়ার অত্যাচারে লেখকের মাথায় হাত (ছবি: এ আই)

বই বের হওয়ার ঘোষণা দিলে অথবা বের করার পর প্রচারণা চালাতে গেলে এদেশের প্রায় প্রতিটি লেখক যে বিড়ম্বনার মুখে পড়েন তা হলো, “আমাকে একটা সৌজন্য কপি দেবেন?” এবং প্রায় ক্ষেত্রেই এই প্রশ্নটি এসে থাকে বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয়-পরিজন তথা সমাজে ‘শুভাকাঙ্খী’ নামে পরিচিত সুধীজনদের কাছ থেকে, যার কারণে বিব্রত হওয়ার মাত্রাটা যে কোনো তুলাদন্ডের বিচারে ভয়াবহ রকমের বেশি থাকে বৈকি। কেমন করে বা ঠিক কবে থেকে বাঙালির মধ্যে এই সৌজন্য কপি চাওয়ার সংস্কৃতি জন্ম নিল তার ঠিকুজি বের করা মুশকিল। তবে এই নিয়ে আমি যতটা ভেবেছি, তা নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার পর তিনি যতটা ভেবেছিলেন তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। ভেবে ভেবে নিজের মতো করে চমৎকার একটা অবজার্ভেশন দাঁড় করিয়েছি আমি।

আমার ধারণা, বইয়ের সৌজন্য কপি চাওয়ার এই সংস্কৃতি চালু পেছনে মূল দায়ী হচ্ছেন প্রাগৈতিহাসিক কালের কোনো লেখক। আমাদের দেশে জাহাজ ভাঙাটিও শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে (Industry অর্থে), কিন্তু বই লেখা এখনও শিল্পের পর্যায় যেতে পারেনি। এদেশে কেবল লেখালিখি করে জীবন ধারণ করেন এমন লেখকের সংখ্যা নেহাৎ কম, তা-ও আবার যে কজন আছেন তাদের অধিকাংশই অনুবাদক।

কিন্তু সকল প্রকাশকই বই প্রকাশ করে জীবিকা নির্বাহ করেন এবং বইয়ের বাজার ভালো না বলা সত্ত্বেও তাদেরকে মন্দ থাকতে দেখা যাচ্ছে না। অর্থাৎ, লেখক একটা বই লিখে সেটি প্রকাশ করতে পারলেই খুশি হয়ে যান, সেই বই থেকে আয় করার কথা ভাবেন না। কালের পরিক্রমায় প্রকাশকপাড়ায় একটা পরিভাষা চালু হয়েছে-মুরগি! অর্থাৎ, নিজের খরচে বই প্রকাশ করতে যায় যেসব লেখক তাদেরকে প্রকাশকরা আড়ালে-আবডালে, নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় মুরগি বলে থাকেন, কারণ প্রকাশকরা নিজেরাও জানেন যে তারা আসলে তাদের জবাই করছেন।

তবে প্রকাশকদের দৃষ্টিতে মুরগি হলেও আমি মনে করি এই সমস্ত লেখক আসলে হাঁস- সোনার ডিম পাড়া হাঁস। কারণ এমন লেখকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ আদায়ের বিনিময়ে বই প্রকাশ করেই নিজের রেভিনিউয়ের বড় অংশটা পকেটে পোরেন এইসব প্রকাশক। ইংরেজিতে এই ধরণের প্রকাশকদের জন্যও একটা গালভরা নাম বরাদ্দ আছে- Vanity Publishers।

তবে এরকম ভ্যানিটি পাবলিশার্স বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অন্যান্য দেশে থাকলেও সেসব দেশের সাধারণ মানুষদের সৌজন্য কপি চাওয়ার প্রবণতা আছে কিনা তা জানা যায়নি। প্রশ্ন হলো, কীভাবে এলো আমাদের সৌজন্য কপি চাওয়ার এই সংস্কৃতি? সেই প্রাগৈতিহাসিক আমল থেকেই এদেশের ভ্যানিটি পাবলিশাররা একটা রেওয়াজ জিইয়ে রেখেছেন, একটা বই প্রকাশের খরচ দেবেন লেখক, আর তা যত সংখ্যক প্রকাশিত হবে তার অর্ধেক অর্থাৎ ৫০০ কপি প্রকাশিত হলে ২৫০ কপি বিক্রির দায়িত্ব লেখক বহন করবেন, বাকি ২৫০ কপি বিক্রির দায়িত্ব বহন করবেন প্রকাশক। লেখকরা যেহেতু নিজের নাম ও লেখা ছাপা অক্ষরে দেখলেই খুশি হয়ে যান, কাজেই তারা এই শর্তে নিজ খরচে বই বের করে বিপুল পরিমাণ বই এর মালিক হন। এর মধ্যে কিছু বই লেখক স্থানীয় লাইব্রেরিগুলোতে দিয়ে  আসেন, বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে কিছু কমিশনের আশায়।  এই বইয়ের খবর জানান দিতে আবার লেখক মশাই  “বের হয়েছে! বের হয়েছে!” শিরোনামে রাস্তার মোড়ে মোড়ে তার বইয়ের প্রচারণামূলক পোস্টার লাগাতে আরো কিছু খরচ গোনেন।

এভাবে যেহেতু অর্ধেক সংখ্যক কপি লেখকের কাছে থেকে যাচ্ছে, যেগুলো খাটের নিচে ফেলে রাখলে উঁই পোকায় খেয়ে ফেলবে, তারচেয়ে তিনি আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব-স্যার-ছাত্রদের উপহার দেন “সৌজন্য সংখ্যা” হিসেবে।  সেই থেকেই এসেছে আমাদের মধ্যে সৌজন্য সংখ্যা চাওয়ার প্রবণতা-কালচার।

কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও কিছু মানসম্পন্ন প্রকাশনী আছে যেগুলো পান্ডুলিপি দেখে মনোনীত হলে বইটি প্রকাশ করে, এবং সম্পূর্ণ নিজ খরচে। শুধু তাই নয়, এদের সাথে লেখকের স্ট্যাম্পে চুক্তি হয় রয়াল্টির। ভালো কথা, শব্দটা রয়ালিটি নয় কিন্তু! যে বইটি যত কপি বিক্রি হয় তার মুদ্রিত মূল্যের ১০-১৫% লেখককে প্রদান করা হয় রয়াল্টি হিসেবে।  এখানে বিনিয়োগ যেহেতু প্রকাশকের, আর লেখককে তিনি রয়াল্টি দিচ্ছেন, কাজেই বিপুল পরিমাণ সৌজন্য কপি দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবে প্রকাশনী ভেদে প্রকাশক সাধারণত ৫-১০টি সৌজন্য কপি দেন যা বেশিরভাগ লেখক সহকর্মী, অগ্রজ লেখক, শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, যাকে উৎসর্গ করা হয়েছে এমন বিশেষ কয়েকজনকে দিয়ে শেষ করে ফেলেন। নিজের শো কেসের জন্যও দুই-এক কপি রাখেন। এরপর কোনো পত্রিকায় রিভিউ এর জন্য, অথবা কোনো পদক এর মনোনয়নের জন্য পাঠাতে হলে লেখককেও নিজের বই টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয়। কিন্তু এই সময়ই ধেয়ে আসে বদঅভ্যাসে আসক্ত বাঙালি জাতি। বই বের হয়েছে এই প্রচারণা লেখক চালাতে গেলেই তথাকথিত ‘সৌজন্য কপি’ চেয়ে তাকে বিব্রত করা হয়, না দিলে গাল ফুলিয়ে বসেও থাকে অনেকে। ফলে অনেক সময় লেখক চক্ষু লজ্জায় পড়ে নিজ খরচে নিজের বই কিনে ‘সৌজন্য কপি’র নাম করে উপহার দেন।

অথচ লেখালিখির কথা বাদ দিয়ে অন্যান্য পেশার কথা যদি ধরি, কোনোটাতেই কিন্তু এভাবে উদ্যোক্তাকে এভাবে হেনস্থা করা হয় না। পরিচিত কেউ একটা ফলের দোকানও যদি দেয়, সবাই চেষ্টা করে তার দোকান থেকে ফল কেনার। একই কাজ যদি লেখকের সাথেও করা হত তাহলে তিনি উৎসাহিত হতেন, লেখালিখিকে পেশা হিসেবে নিতে পারতেন। এতে তার বা প্রকাশকের লগ্নিকৃত অর্থ যেমন উঠে আসত, তেমন বিক্রিত বইয়ের অর্থ থেকে রয়াল্টি পেয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতেন লেখক।

এদেশে যেদিন বাঙালি সৌজন্য কপি চাওয়ার অভ্যাস ভুলে বই কিনতে শিখবে সেদিনই লেখকরা লেখালিখিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার কথা ভাবতে সাহস করবেন।

  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর সর্বশেষ নিউজ পড়তে ক্লিক করুন: সর্বশেষ
  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর ফেসবুক পেজটি ফলো করুন: dailysabasbd

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT