গাজার খান ইউনিসে খাদ্যের আশায় লাইনে দাঁড়ানো অসহায় মানুষের ওপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ট্যাংক শেল, মেশিনগান ও ড্রোন হামলায় মঙ্গলবার অন্তত ৭০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও অন্তত ২০০ জন। সকাল থেকেই গাজাজুড়ে হামলায় মোট ৮৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বহু আহতের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকরা।
এই হামলাটি ছিল গাজার তথাকথিত “সহায়তা বিতরণ কেন্দ্র” গুলোর আশপাশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রাণঘাতী ঘটনা। এর আগে সোমবারে রাফাহ অঞ্চলে ৩৮ জন প্রাণ হারায়। গত তিন সপ্তাহ ধরে এই সহায়তা কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে একই ধরনের হামলায় ৩০০’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে ২,৮০০-এর বেশি।
মঙ্গলবার সকালবেলা খান ইউনিসের পূর্ব সড়কে ময়দা সংগ্রহের আশায় জড়ো হয়েছিল কয়েকশ মানুষ। তখনই ইসরায়েলি ড্রোন থেকে গুলি বর্ষণ শুরু হয়, কিছুক্ষণ পর ট্যাংক থেকে একাধিক শেল নিক্ষেপ করা হয়।
গাজা সিভিল ডিফেন্সের মুখপাত্র মাহমুদ বাসসাল বলেন, “প্রথমে ড্রোন গুলি চালায়, তারপর ট্যাংক থেকে গোলা ছোড়া হয়। এতে শতাধিক মানুষ মারা যান বা গুরুতরভাবে আহত হন।”
আল জাজিরার প্রতিবেদক হানি মাহমুদ বলেন, “ট্যাংক, ভারী মেশিনগান এবং ড্রোন হামলা যেন বৃষ্টির মতো বর্ষণ হচ্ছিল,” প্রত্যক্ষদর্শীদের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান।
বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তারা এমন নৃশংস দৃশ্য কখনও দেখেননি। ৩৮ বছর বয়সী সাঈদ আবু লিবা বলেন, “ডজনখানেক বেসামরিক মানুষ, শিশু সহ, মারা গেছে। কেউ সাহায্য করার মতো অবস্থায় ছিল না।” ইউসুফ নোফাল একে “নির্মম গণহত্যা” বলে অভিহিত করেন। তিনি জানান, “লোকজন মাটিতে পড়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ছিল, সৈন্যরা পালিয়ে যাওয়া লোকদের ওপরও গুলি চালাচ্ছিল।”
মোহাম্মদ আবু কাশফা বলেন, “আমি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেছি। চারপাশে শুধু গুলি, ট্যাংকের গোলা।” নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, অনেক লাশ এতটাই ছিন্নভিন্ন হয়েছে যে তাদের চেনা যাচ্ছে না।
এই সহায়তা বিতরণ কার্যক্রম চালাচ্ছে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (GHF), যার পেছনে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। মে মাসের শেষ দিকে যখন ইসরায়েল তিন মাসের অবরোধ সামান্য শিথিল করে, তখনই এই কার্যক্রম শুরু হয়। তবে জাতিসংঘ ও প্রধান মানবিক সংস্থাগুলো এই প্রকল্পে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তাদের অভিযোগ, এই তৎপরতা মানবিক চাহিদার বদলে ইসরায়েলি সামরিক লক্ষ্যকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং দীর্ঘদিনের সাহায্য সংস্থাগুলোকে পাশ কাটিয়ে চলছে।
ঘনঘন এই সহিংসতার পরও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী প্রতিবারই দাবি করেছে, তারা ‘সন্দেহভাজন’ ব্যক্তিদের দিকে ‘সতর্কতামূলক গুলি’ ছুঁড়েছে, যদিও তারা কখনো নিশ্চিত করেনি সেই গুলিতে কেউ মারা গেছে কিনা।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। তার উপমুখপাত্র ফারহান হক বলেন, “খাদ্যের জন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষকে গুলি করে হত্যা — এটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।” তিনি জানান, শুধুমাত্র মঙ্গলবার পর্যন্ত সহায়তা সংগ্রহ করতে গিয়ে ৩৩৮ জন নিহত এবং ২,৮০০ জন আহত হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, গাজায় বর্তমানে মাত্র ১৭টি হাসপাতাল আংশিকভাবে চালু আছে — যেগুলোর মোট শয্যা সংখ্যা যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের চেয়ে ৪৫ শতাংশ কম। দীর্ঘ ১০০ দিনেও সেখানে জ্বালানির প্রবেশ বন্ধ, যার ফলে হাসপাতালগুলো কার্যত অচল হয়ে পড়ছে।
WHO-র প্রতিনিধির ভাষায়, “আমরা জরুরি ভিত্তিতে গাজায় জ্বালানি সরবরাহের অনুমতি চাই। এই হাসপাতালে বিদ্যুৎ না থাকলে আহতদের বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।”
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, WHO, AFP