
ঊষার আলো তখনো পুরোপুরি ছড়ায়নি। আকাশে কেবল নরম নীল, আর দোপাট্টা নদীর উপর লেগে থাকা পাতলা কুয়াশা। ঠিক এই মুহূর্তে ডিমের চরকে দেখা যায় তার সত্যিকারের রূপে। দীর্ঘ বালুরাশি, যেনো নিঃশব্দ জীবন্ত একটি সত্তা। বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবনের পাশে অবস্থিত এই চর প্রতিদিন জোয়ার-ভাটার টানে নিজের রূপ বদলায়। আজ যেখানে হাঁটছেন, কয়েক ঘণ্টা পরেই সেখানে সমুদ্রের ঢেউ এসে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
ডিমের চর সুন্দরবনের উপকূলঘেঁষা একটি নবীন বালুচর, যা প্রতিদিন জোয়ার-ভাটায় বদলায় তার রূপ। চরটির ভূপ্রকৃতি মূলত বালু, সিল্ট এবং সামুদ্রিক পলি দ্বারা গঠিত। এই পরিবর্তনশীল প্রকৃতি এই চরকে অনন্য করে তুললেও, একই সঙ্গে অত্যন্ত নাজুকও করে তোলে। যে বিস্তৃত বালুচর দেখা যায়, জোয়ার এলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তা পুরোপুরি ঢেকে যায় সমুদ্রের জলে। এটাই ডিমের চরের মৌলিক প্রকৃতি।
জীববৈচিত্র্যের দিক থেকেও ডিমের চর অনবদ্য। ম্যানগ্রোভ গাছের সারি, আর ওপরে উড়ে চলা সাদা বক সব মিলিয়ে যেনো মনে হয় প্রকৃতি এখানে নতুন করে পৃথিবী সাজিয়েছে। মাঝে মাঝে চিত্রা হরিণ নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় গাছের আড়ালে। নদীর পানিতে দেখা মেলে শুশুকের। আর সূর্যাস্তের মুহূর্তে পুরো চরটি সোনালি আভায় ডুবে যায়। যেনো কেউ রংতুলির নরম আচড়ে রাঙিয়ে দিয়েছে। এই চরের মাটি উর্বর হওয়ায় এখানে দেখা মিলবে নতুন করে অঙ্কুরিত হওয়া সুন্দরী, গরান এবং অন্যান্য ম্যাংগ্রোভ উদ্ভিদের। এদের মাঝে সব থেকে বেশি যে গাছটি নজরে আসবে তা হলো সারি সারি গেওয়া।
এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের মাঝেও রয়েছে প্রতিকূলতার হাতছানি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শঙ্কা ও মানুষের লাগামহীন কার্যকলাপ ক্রমান্বয়ে এর রূপকে করে দিচ্ছে ম্লান। মানবসৃষ্ট দূষণ বর্তমানে ডিমের চরের সবচেয়ে বড় হুমকি। যত্রতত্র ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক, খাবারের প্যাকেট, পানির বোতল এবং মোটরবোটের তেল নিঃসরণ চরের মাটি ও পানিকে প্রতিনিয়ত করছে দূষিত। এসব বর্জ্য ভেঙে-ভেঙে পরিণত হয় মাইক্রোপ্লাস্টিকে। গুরুতর ক্ষতি ডেকে আনে কাঁকড়া, বক, মাছ, শুশুকসহ জীববৈচিত্র্যের সরল সৌন্দর্যের ওপর। এদিকে অতিরিক্ত নৌযান চলাচলের ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে ঢেউ। যা প্রকৃতির স্বাভাবিক ক্ষয়প্রক্রিয়াকে দ্রুততর বৃদ্ধি করে প্রকৃতিকে করে তুলছে অস্থিতিশীল।
ডিমের চরকে ঘিরে থাকা বাঘ, হরিণ, শিয়াল, পরিযায়ী পাখি, কাঁকড়া এবং শুশুকের জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল হলো সুন্দরবন। কিন্তু পর্যটকদের ভিড়, শব্দ দূষণ এবং বর্জ্য ফেলার কারণে অনেক প্রাণী তাদের স্বাভাবিক আচরণ থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। বিশেষ করে বক, মাছরাঙা ও সামুদ্রিক পাখিগুলো খাদ্য অনুসন্ধানে পড়ছে বাধার মুখে। ডিমের চর ও আশপাশের এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবিকা নির্ভর করে মাছ ধরা, মৌয়ালগিরি, গোলপাতা সংগ্রহ এবং পর্যটন সেবার ওপর। কিন্তু জোয়ার-ভাটা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস ও চরক্ষয়ের কারণে তাদের প্রতিদিন নতুন ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়। প্রতিবছর বঙ্গপসাগর থেকে ধেয়ে আসা প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয় এই নির্মল বালুচর। এছাড়া অসচেতন পর্যটকের আচরণ, বনে প্রবেশ, ম্যানগ্রোভের শাখা ভাঙা, আবর্জনা ফেলা স্থানীয়দের জন্য তৈরি করছে দ্বিগুণ চাপ।
ডিমের চর শুধু একটি বালুচর নয় এটি বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূগঠন, জীববৈচিত্র্য, ম্যানগ্রোভ বন এবং নীল অর্থনীতির একটি আন্তঃসংযুক্ত ইকোসিস্টেম। এখানকার সৌন্দর্য যেমন বিস্ময় জাগায়, তেমনই এর নাজুকতা আমাদের সতর্ক করে। এই চরকে টিকে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে প্রাকৃতিক ক্ষয়প্রক্রিয়া, মানবসৃষ্ট দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে । আর এ যুদ্ধে প্রয়োজন সচেতন পর্যটক, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, স্থানীয় জনগণের সম্পৃক্ততা এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার দৃঢ় নীতিমালা।
সঠিক ব্যবস্থাপনা, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং দায়িত্বশীল আচরণ বদলে দিতে পারে এই চরের ভবিষ্যত, হয়ে উঠতে পারে এক অপার সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক এবং গবেষণা ক্ষেত্র। সঠিক উদ্যোগ, স্বদিচ্ছা ও সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই চর উন্মোচন করতে পারে মৎস সম্পদ আহরণ এবং নীল অর্থনীতির এক নতুন দ্বার। সুষ্ঠু ও কাঠামোগত উপায়ে ইকো-ট্যুরিজমের ব্যবস্থা করতে পারলে, এই চর ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে হয়ে উঠবে এক নতুন ঠিকানা।
ডিমের চরকে যদি আমরা বাঁচাতে পারি, তবে এটি হবে বাংলাদেশের উপকূল রক্ষার এক অনন্য উদাহরণ। আর যদি অবহেলা করি, তবে হারিয়ে যাবে হাজারো সম্ভাবনাময়ী এক প্রাকৃতিক সম্পদ যার সৌন্দর্য আর জেগে উঠবে না কখনোই। ডিমের চর এখনো স্বপ্নের মতো, কারণ প্রকৃতি এখনো পুরোপুরি হার মানেনি। আমরা যদি চাই, আমাদের একটু সচেতনতা আর সহজ কিছু পদক্ষেপই দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারে এই চরের প্রাণ। আমাদের প্রতিজ্ঞায় যুক্ত করতে পারি অপরূপ প্রকৃতির রূপে আবর্জনা না ফেলা, জাহাজ চলাচলে কঠোরতা আর পর্যটনের সঠিক নিয়ম মেনে চলা। ডিমের চর এক বই যা প্রতিদিন নতুন অধ্যায় লেখে। ঢেউ তার কণ্ঠস্বরে নতুন গল্প শোনায়, ম্যানগ্রোভ তার শ্বাস, আর মানুষের আচরণ তার ভবিষ্যত। এই চর শুধু সৌন্দর্য উপভোগের নয় সংরক্ষণেরও বটে। যেনো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন মাথা উঁচু করে, দুহাত প্রসারিত করে, উচ্চ কণ্ঠে গর্বের সাথে বলতে পারে “হ্যাঁ! আমার দেশের সৌন্দর্য এমনি অমলিন আর সুশোভিত!”
মেজবাউল হক রিয়াদ, মোজাহিদুল ইসলাম, মোহনা তালুকদার, ইসরাত জাহান ইমা
ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়