আসন্ন ঈদুল আজহা উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় গরু-ছাগলসহ কোরবানির পশু কেনাবেচার জন্য ২১টি হাট বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) ১০টি অস্থায়ী ও ১টি স্থায়ী হাট এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) ৯টি অস্থায়ী ও ১টি স্থায়ী হাট বসবে। তবে এবারের প্রস্তুতি নানা কারণে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে।
চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ৭ জুন ঈদুল আজহা অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকায় সময় খুব বেশি হাতে নেই। অথচ আগের বছরগুলোতে এই সময়ে হাটের ইজারা প্রক্রিয়া অনেকটাই সম্পন্ন হয়ে যেত। কিন্তু এবার ডিএসসিসিতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে মেয়র হিসেবে শপথ করানোর দাবিতে চলমান আন্দোলনের কারণে নগর ভবনের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। ফলে দক্ষিণ সিটির ৯টি হাটের কোনোটির ইজারাই এখনো চূড়ান্ত করা যায়নি।
ডিএসসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ৫টি হাটের ইজারা প্রক্রিয়ার প্রায় ৮০ শতাংশ শেষ হয়েছে, শুধু ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া বাকি। এই হাটগুলো হলো- উত্তর শাহজাহানপুর মৈত্রী সংঘের পাশের খোলা জায়গা, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পশ্চিম পাশে, রহমতগঞ্জ ক্লাবের মাঠ, আমুলিয়া আলীগড় মডেল কলেজের উত্তরের মাঠ এবং হাজারীবাগে ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজির পূর্ব পাশে। এছাড়া আরও ৩টি হাটের দরপত্র খুলে সর্বোচ্চ দরদাতা ঠিক করা হয়েছে, তবে কার্যাদেশ দেওয়া যায়নি।
অন্যদিকে ডিএনসিসির কার্যক্রম তুলনামূলক এগিয়ে। তাদের ১১টি হাটের মধ্যে ২টির দরপত্র প্রক্রিয়া শেষ এবং বাকিগুলোর দরপত্র আহ্বান ও মূল্য নির্ধারণ চলছে। ডিএনসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ২৮ মে’র মধ্যে সব হাটের ইজারা প্রক্রিয়া শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
ডিএনসিসির হাটগুলোর তালিকা:
১. ভাটারা সুতিভোলা খালসংলগ্ন খালি জায়গা
২. উত্তরা দিয়াবাড়ী ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টরসংলগ্ন বউ বাজার এলাকার খালি জায়গা
৩. বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং এম-৪, এম-৫ ও এন-৪ ব্লক (লেকের উত্তর পার্শ্বে আংশিক)
৪. সানভ্যালি (আংশিক) এর খালি জায়গা
৫. মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গা
৬. মোহাম্মদপুর বছিলা ৪০ ফুট রাস্তাসংলগ্ন খালি জায়গা
৭. ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সংলগ্ন খালি জায়গা
৮. খিলক্ষেত থানাধীন ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের মস্তুল চেকপোস্ট সংলগ্ন পশ্চিম পাড়ার খালি জায়গা
৯. ভাটুলিয়া সাহেব আলী মাদ্রাসা থেকে ১০নং সেক্টর রানাভোলা স্লুইসগেট পর্যন্ত খালি জায়গা
১০. মিরপুর কালশী বালুর মাঠের খালি জায়গা
১১. খিলক্ষেত বনরূপা আবাসিক এলাকার খালি জায়গা
ডিএসসিসির হাটগুলোর তালিকা:
১. উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা
২. পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পশ্চিম পার্শ্বে নদীর পাড়ে খালি জায়গা
৩. দনিয়া কলেজের পূর্ব পার্শ্বে ও সনটেক মহিলা মাদ্রাসার পূর্ব-পশ্চিমের খালি জায়গা
৪. সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পার্শ্বের খালি জায়গা ও ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল
৫. রহমতগঞ্জ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা
৬. শ্যামপুর কদমতলী ট্রাক স্ট্যান্ডসংলগ্ন খালি জায়গা
৭. ইন্সটিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজের পূর্ব পাশের খালি জায়গা
৮. কমলাপুর সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের পূর্ব পাশের খালি জায়গা
৯. আমুলিয়া আলীগড় মডেল কলেজের উত্তর পূর্ব পার্শ্বের খালি জায়গা
এদিকে কোরবানিতে এবার হাটের ইজারার টাকাও বেশ চমকপ্রদ। যেমন ডিএসসিসির পোস্তগোলা শ্মশানঘাট হাটের মূল্য ২ কোটি ৬৯ লাখ, আর ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজির পূর্ব পাশে ৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ডিএনসিসির উত্তরা দিয়াবাড়ির হাটের দর ৮ কোটি ৯০ লাখ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় ৯টি হাটের মধ্যে রয়েছে- উত্তর শাহজাহানপুর খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী সংঘ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গায় বসানো হাটের ইজারা মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৭২ হাজার ৩৩৪ টাকা, দনিয়া কলেজের পূর্ব পার্শ্বে ও সনটেক মহিলা মাদ্রাসার পূর্ব পশ্চিমের খালি জায়গার ইজারা মূল্য ৪ কোটি ৭২ লাখ ৫ হাজার ৬১১ টাকা, সাদেক হোসেন খোকা মাঠের দক্ষিণ পার্শ্বের খালি জায়গাসহ ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনালের জায়গায় বসা হাটের ইজারা মূল্য ৪ কোটি ৬৪ লাখ ১৫ হাজার ২৮০ টাকা।
এছাড়া পোস্তগোলা শ্মশানঘাটের পশ্চিম পার্শ্বের নদীর পাড়ে খালি জায়গায় হাটের ইজারা মূল্য ধরা হয়েছে ২ কোটি ৬৯ লাখ ৯৮ হাজার ২০০ টাকা, ইন্সটিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজের পূর্ব পাশের খালি জায়গার হাটের মূল্য ৪ কোটি ৯৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪০০ টাকা, কমলাপুর সাদেক হোসেন খোকা কমিউনিটি সেন্টারের পূর্ব পাশের খালি জায়গার হাটের মূল্য ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৭৫ লাখ ২৪ হাজার টাকা, রহমতগঞ্জ ক্লাবসংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গায় হাটের মূল্য ৬২ লাখ ৬৭ হাজার ৭৪ টাকা, শ্যামপুর কদমতলী ট্রাক স্ট্যান্ডসংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের মূল্য ৬৬ লাখ ৯৬ হাজার ২০ টাকা এবং আমুলিয়া আলীগড় মডেল কলেজের উত্তর পূর্ব পার্শ্বের খালি জায়গায় হাটের মূল্য ৫৩ লাখ টাকা সরকারি ইজারা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের হাটগুলোর মধ্যে মিরপুর ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইস্টার্ন হাউজিংয়ের খালি জায়গার হাটের ইজারা মূল্য ধরা হয়েছে ১ কোটি ৩৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৮৬ টাকা, মোহাম্মদপুর বছিলার ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের মূল্য ২ কোটি ২০ লাখ টাকা, ঢাকা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের মূল্য ৬৪ লাখ ২ হাজার ৪০০ টাকা, খিলক্ষেত থানার ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের মস্তুল চেকপোস্ট সংলগ্ন পশ্চিম পাড়ার খালি জায়গার হাটের ইজারা মূল্য ১ কোটি ৭ হাজার ৫০০ টাকা।
এছাড়া ভাটারা সুতিভোলা খালসংলগ্ন খালি জায়গায় হাটের ইজারা মূল্য ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, উত্তরা দিয়াবাড়ি ১৬ ও ১৮ নম্বর সেক্টর সংলগ্ন বউবাজার এলাকার খালি জায়গায় হাটের ইজারা মূল্য ৮ কোটি ৯০ লাখ, ইস্টার্ন হাউজিং এম-৪, এম-৫ ও এন-৪ ব্লক (লেকের উত্তর পার্শ্বে আংশিক) জায়গায় হাটের মূল্য ১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা, সানভ্যালির (আংশিক) খালি জায়গায় হাটের মূল্য ১ কোটি ৭৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ভাটুলিয়া সাহেব আলী মাদ্রাসা থেকে ১০ নং সেক্টর রানাভোলা স্লুইসগেট পর্যন্ত খালি জায়গার হাটের ইজারা মূল্য ৮১ লাখ ২০ হাজার টাকা, মিরপুর কালশী বালুর মাঠের খালি জায়গায় হাটের মূল্য ৮০ লাখ টাকা এবং খিলক্ষেত বনরূপা আবাসিক এলাকার খালি জায়গায় হাটের ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা সরকারি ইজারা মূল্য ধরা হয়েছে।
কোরবানী ঘিরে শুধু পশুর কেনাবেচা নয়, পুরো দেশজুড়ে বিরাট অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়। খামারি ও কৃষকরা তাদের গবাদি পশু বিক্রি করে, বাজারে মসলার বিক্রি বাড়ে, পশুর খাবার, ছুরি-কাঁটার দোকান, মাংস কাটার লোকজনের আয় বাড়ে। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি এবং সংরক্ষণেও বড় অঙ্কের লেনদেন হয়।
এ বছর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, কোরবানির জন্য দেশে গবাদিপশুর প্রাপ্যতা প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার। এর মধ্যে গরু-মহিষ ৫৬ লাখের বেশি। পশু বিক্রির সময় সরকারের নির্ধারিত ৫ শতাংশ হারে রাজস্ব দিতে হবে। শুধু গরু-মহিষ বিক্রি থেকেই প্রায় ৩০ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার আশা করা হচ্ছে। ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য মিলিয়ে মোট রাজস্ব প্রায় ৬০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।
কোরবানির ঈদে দেশের মোট চামড়ার ৬০ শতাংশ সংগৃহীত হয়। এই সময় চামড়া নিয়ে দাম নিয়ে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও সিন্ডিকেট ভাঙতে সরকার ৩০ হাজার টন লবণ সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লবণ দিয়ে সংরক্ষণের মাধ্যমে চামড়া নষ্ট হওয়া ঠেকানো হবে। এছাড়া চামড়ার ব্যবসায়, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়।
সরকার জানিয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। শুধু পশুর চামড়া সঠিকভাবে বাজারজাত করতে পারলে কোরবানি আরও বেশি মানুষের উপকারে আসবে।
সব মিলিয়ে এবার ঈদুল আজহা ঘিরে রাজধানীসহ দেশজুড়ে পশুর হাট ও কোরবানিকেন্দ্রিক অর্থনীতি আরও একবার বড় অঙ্কের লেনদেন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। তবে সময় মতো হাটের ইজারা প্রক্রিয়া শেষ ও প্রস্তুতি নিতে না পারলে ভোগান্তির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।