দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে। আগে এটি মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে সীমিত থাকলেও এখন বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত এক বছরে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, একসময় বেসরকারি খাতের সাত-আটটি ব্যাংক একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকায় নিয়মবহির্ভূতভাবে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণ করা হয়েছিল। সরকার পরিবর্তনের পর এসব অনিয়মিত ঋণ একে একে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে, ফলে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। পাশাপাশি, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত নীতিমালায় পরিবর্তন আনার ফলে এ বৃদ্ধিতে প্রভাব পড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২০.২০ শতাংশ। এক বছর আগে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭০ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা বা ৫.৯৩ শতাংশ। অর্থাৎ, এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা ২.৮১ গুণের বেশি। বিশেষভাবে, ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫০ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের এই প্রবৃদ্ধি মূলত কিছু নির্দিষ্ট ব্যাংকের অনিয়মের ফল। তবে সব ব্যাংকেই পরিস্থিতি একই রকম নয়।
অন্যদিকে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। গত এক বছরে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭০ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৪২.৮৩ শতাংশ। এক বছর আগে এই পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা বা ৪.৮২ শতাংশ।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের মধ্যে জনতা ব্যাংকের অবস্থান শীর্ষে, যার খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খেলাপি ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলো হলো—বেক্সিমকো (২৩ হাজার কোটি টাকা), এস আলম গ্রুপ (১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা), অ্যাননটেক্স (৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা), ক্রিসেন্ট (৩ হাজার ৮০০ কোটি টাকা), থার্মেক্স গ্রুপ (২ হাজার ২০০ কোটি টাকা) এবং সিকদার গ্রুপ (৮৫০ কোটি টাকা)।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ তুলনামূলকভাবে কমেছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এ খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৪.১৩ শতাংশ। এক বছর আগে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এই পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা বা ৪.৮২ শতাংশ।
বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রেও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে এসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৪৩৩ কোটি টাকা বা ১৪.৩৭ শতাংশ, যা এক বছর আগে ছিল ৫ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বা ১৩.৮৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এটি ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘আমরা আগেই সতর্ক করেছিলাম, খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি আপাতত উন্নতির দিকে যাবে না। বাস্তবে সেটিই ঘটছে। নতুন তথ্য অনুযায়ী, খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে।’’
গভর্নর আরও জানান, অতীতে খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ কিছুটা কম দেখানো হতো। একসময় এটি ৯ শতাংশ দেখানো হলেও বাস্তবে তা বর্তমানে ২০ শতাংশের বেশি। পাশাপাশি, নীতিমালার পরিবর্তনের ফলে ১৮০ দিনের পরিবর্তে এখন ৯০ দিনের মধ্যে ঋণ খেলাপি হয়ে যাচ্ছে, যা খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির আরেকটি কারণ।