নোটিশ:
শিরোনামঃ

আফ্রিকা উপনিবেশকরণ: ১৮৮৪-১৮৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনে কী ঘটেছিল?

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫
  • ৩২ বার দেখা হয়েছে
বার্লিন সম্মেলন, যেখানে পশ্চিমা নেতারা আফ্রিকা ভাগ করার জন্য মিলিত হন, ছবি: উইকিকমন্স
বার্লিন সম্মেলন, যেখানে পশ্চিমা নেতারা আফ্রিকা ভাগ করার জন্য মিলিত হন, ছবি: উইকিকমন্স

আফ্রিকা উপনিবেশকরণ : ১৮৮৪-১৮৮৫ সালের বার্লিন সম্মেলনে ইউরোপীয় শক্তিগুলি আফ্রিকা বিভক্ত করার নীতি নির্ধারণ করে এবং উপনিবেশবাদ তীব্রতর হয়।

এই মাসে ১৪০ বছর পূর্ণ হলো সেই ঘটনার, যখন পশ্চিমা শক্তিগুলো আফ্রিকানদের উপেক্ষা করে নিজেদের মধ্যে এই মহাদেশের মালিকানা ভাগ করে নেয়।

আফ্রিকা দখলের সূচনা

১৯ শতকের শেষ দিকে ইউরোপীয় দেশগুলো আফ্রিকাকে তাদের নতুন শিল্প খাতের জন্য স্থায়ী সম্পদ হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। দীর্ঘদিনের বাণিজ্যের চেয়েও তারা আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ চাইছিল। পাশাপাশি, তারা আফ্রিকাকে “উন্নয়ন ও সভ্যতা” দেওয়ার অজুহাতও দেখিয়েছিল।

এর ফলে শুরু হয় “Scramble for Africa” বা আফ্রিকা ভাগাভাগির প্রতিযোগিতা। ব্রিটেন, পর্তুগাল, ফ্রান্স, জার্মানি, এবং বেলজিয়ামের রাজা লিওপোল্ড দ্বিতীয় স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে চুক্তি করতে স্কাউট পাঠানো শুরু করেন, কখনো কেনার মাধ্যমে, কখনো পতাকা পুঁতে, কখনো সরাসরি দাবি জানিয়ে।

তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন পশ্চিম আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে, আবার ফ্রান্স ও রাজা লিওপোল্ড মধ্য আফ্রিকা নিয়ে বিরোধে লিপ্ত হয়।

বার্লিন সম্মেলন

সম্পূর্ণ যুদ্ধ এড়াতে ইউরোপীয় দেশগুলো ১৮৮৪-৮৫ সালে জার্মানির বার্লিনে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। কিন্তু কোনো আফ্রিকান রাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

জার্মান চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্ক বার্লিনে এই বৈঠকের আয়োজন করেন। এতে মূল আলোচনা ছিল আফ্রিকার মানচিত্র তৈরি এবং কে কোন অঞ্চল পাবে তা নির্ধারণ করা।

কারা উপস্থিত ছিল?

মোট ১৪টি দেশের কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূতরা এই সম্মেলনে অংশ নেন। প্রধান ভূমিকা পালন করে ফ্রান্স, জার্মানি, ব্রিটেন ও পর্তুগাল, কারণ এরা তখন আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিল।

অন্যান্য অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে ছিল—

  • অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি
  • ডেনমার্ক
  • রাশিয়া
  • ইতালি
  • সুইডেন-নরওয়ে
  • স্পেন
  • নেদারল্যান্ডস
  • অটোমান সাম্রাজ্য (তুরস্ক)
  • যুক্তরাষ্ট্র

ফলাফল

তিন মাস ধরে আলোচনার পর ইউরোপীয় শক্তিগুলো “General Act” নামে ৩৮টি ধারা স্বাক্ষর করে, যা আফ্রিকার উপনিবেশীকরণকে বৈধতা দেয়।

  • ইউরোপীয় দেশগুলো নতুন উপনিবেশ তৈরি করে এবং আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করে।
  • কঙ্গো ও নাইজার নদী অববাহিকায় মুক্ত বাণিজ্যের নীতি গৃহীত হয়।
  • রাজা লিওপোল্ডের “International Congo Society” স্বীকৃতি পায়, যা পরবর্তীতে কঙ্গো ফ্রি স্টেট হয়ে ওঠে। এই অঞ্চল ভয়াবহ শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়, যেখানে হাজার হাজার মানুষকে রাবার চাষে বাধ্য করা হয়, অনেকে মৃত্যুবরণ করে বা হাত-পা কাটার শাস্তি পায়।
  • কাগজে-কলমে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও বাস্তবে তা চলমান ছিল।
  • সম্মেলনে বলা হয়, শুধু পতাকা পুঁতে অঞ্চল দাবি করা যাবে না; বরং “কার্যকর দখল” অর্থাৎ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।

কে কোন অঞ্চল পেল?

বার্লিন সম্মেলনে সীমানা চূড়ান্ত হয়নি, তবে পরে বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে আফ্রিকার ভাগ নির্ধারিত হয়:

  • ফ্রান্স: পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার বিশাল অংশ, আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া।
  • ব্রিটেন: দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, নাইজেরিয়া, ঘানা, সুদান, মিশর।
  • পর্তুগাল: মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা।
  • জার্মানি: নামিবিয়া, তানজানিয়া, ক্যামেরুন, টোগো।
  • বেলজিয়াম: কঙ্গো ফ্রি স্টেট।
  • ইতালি: সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া।
  • স্পেন: ইকুয়েটোরিয়াল গিনি।

লিবারিয়া ও ইথিওপিয়া উপনিবেশীকরণ থেকে রক্ষা পায়, তবে ইথিওপিয়া ইতালির আক্রমণের মুখে পড়ে।

INTERACTIVE - Berlin conference 1885 Africa colonial map 1880 1914-1739884987

সম্মেলনের প্রভাব

বার্লিন সম্মেলন আফ্রিকায় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠার সূচনা করেনি, বরং তা ত্বরান্বিত করেছে। ১৮৮৪ সালে যেখানে মাত্র ২০% আফ্রিকা ইউরোপীয়দের নিয়ন্ত্রণে ছিল, ১৮৯০ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯০%-এ।

  • ইউরোপীয়রা ইচ্ছামতো সীমান্ত তৈরি করে, যা পরবর্তীকালে জাতিগত ও রাজনৈতিক সংঘর্ষ সৃষ্টি করে।
  • স্বাধীনতা লাভের পর (১৯৫০-৭০ এর দশকে), অধিকাংশ আফ্রিকান দেশ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ভুগতে থাকে।
  • উপনিবেশের ফলে আফ্রিকার অর্থনীতি ও প্রশাসনিক কাঠামো বিধ্বস্ত হয়, যার প্রভাব আজও বিদ্যমান।

তানজানিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জুলিয়াস নিরেরের কথায়—
“আমরা এমন কৃত্রিম জাতি পেয়েছি, যা বার্লিন সম্মেলনে তৈরি হয়েছিল, এবং এখন আমরা এগুলোকে বাস্তব রাষ্ট্রে পরিণত করতে সংগ্রাম করছি।”

এই সম্মেলনের সিদ্ধান্ত আজও আফ্রিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব বিস্তার করছে।

লেখক: শোলা লাওয়াল (সাংবাদিক)

  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর সর্বশেষ নিউজ পড়তে ক্লিক করুন: সর্বশেষ
  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর ফেসবুক পেজটি ফলো করুন: dailysabasbd

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT