
দীর্ঘদিনের শিক্ষক সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুটেক্স) অবশেষে নতুন আশার আলো দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন বিভাগে ক্লাস ও ল্যাব পরিচালনায় যে তীব্র শিক্ষক ঘাটতি তৈরি হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে বুটেক্স প্রশাসন নেয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এখন থেকে এমএসসি ডিগ্রি ছাড়াই শুধু বিএসসি ডিগ্রিধারী প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও শিক্ষক পদে আবেদন করতে পারবেন।
এই সিদ্ধান্তের ফলেই সম্প্রতি বেশ কয়েকজন তরুণ শিক্ষক বুটেক্সে যোগ দিয়েছেন—যারা কিছুদিন আগেও এই একই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী ছিলেন। যে শ্রেণিকক্ষে বসে একসময় তারা নিজেদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতেন, আজ সেই শ্রেণিকক্ষেই দাঁড়িয়ে তারা গড়ে তুলছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ। ছাত্রজীবন থেকে শিক্ষকতার মঞ্চে এই প্রত্যাবর্তন শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং বুটেক্সের শিক্ষাঙ্গণের জন্যও একটি অনুপ্রেরণামূলক অধ্যায়। তাঁদের মধ্য থেকেই কয়েকজন শিক্ষকের শিক্ষা ও পেশাজীবনের গল্প তুলে ধরেছেন মো. রিফাত খান।
৪২তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
প্রভাষক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
বুটেক্সে তাঁর ছাত্রজীবনের শুরুটা ছিল কিছুটা অনিশ্চয়তায় ভরা। তখন ক্যারিয়ার–সংক্রান্ত ধারণা বা সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব খুব একটা স্পষ্ট ছিল না। একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকলেও কোথায় ভর্তি হবেন—এ নিয়ে তিনি ছিলেন দ্বিধায়। শেষ পর্যন্ত কোচিং সেন্টারের বড় ভাই ও বাবার সিদ্ধান্তে তিনি বুটেক্সে ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই ভালো ফল করার প্রতি তাঁর মনোযোগ ছিল সুস্পষ্ট। প্রথম সেমিস্টারে ভালো ফলাফলের পরই তিনি জানতে পারেন—বিভাগে প্রথম স্থান ধরে রাখতে পারলে শিক্ষকতা পেশায় আসার সুযোগ তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশার সামাজিক মর্যাদা এবং প্রথম সেমিস্টারের ফলাফল তাঁকে এই পেশার প্রতি গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করে।
তাঁর ভাষায়, আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাতেই তিনি বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে স্নাতক সম্পন্ন করেন এবং নিজ বিভাগেই শিক্ষক হিসেবে ফিরে আসেন। যে ক্লাসরুমে একসময় তিনি নিজে বসতেন, আজ সেখানে দাঁড়িয়ে পাঠদান করতে পারা তাঁর কাছে গর্ব, আনন্দ ও তৃপ্তির এক অনন্য অনুভূতি।
উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন ও গবেষণাকে সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের কল্যাণে কাজ করাই তাঁর মূল লক্ষ্য। ইতোমধ্যে তাঁর একাধিক গবেষণা প্রবন্ধ স্বনামধন্য জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং আরও কয়েকটি গবেষণা ও প্রকাশনার সঙ্গে তিনি যুক্ত আছেন। তিনি জানান, একসময় যাঁরা তাঁর শিক্ষক ছিলেন, আজ তাঁদের সহকর্মী হিসেবে পাশে পাওয়াটাই তাঁর সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। ভবিষ্যৎ শিক্ষক হতে আগ্রহীদের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ—ছাত্রজীবন থেকেই গবেষণায় যুক্ত হওয়া এবং কিছু সময় শিল্পপ্রতিষ্ঠানে কাজ করে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করা।
৪৫তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
প্রভাষক, টেক্সটাইল ম্যাটেরিয়ালস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
বুটেক্সে তাঁর ছাত্রজীবনের শুরুটা ছিল ভিন্নধর্মী অভিজ্ঞতায় ভরা। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে এইচএসসি শেষ করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পেলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বুটেক্সে ভালো অবস্থানে ভর্তি হন। শুরুতে ছোট ক্যাম্পাস ও সীমিত সুযোগ–সুবিধা নিয়ে কিছুটা হতাশা থাকলেও সিনিয়র–জুনিয়রদের আন্তরিক সম্পর্ক তাঁকে সবসময় অনুপ্রাণিত করেছে।
প্রথম বর্ষেই শিক্ষকতা পেশা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন তিনি। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্যুরে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের আগ্রহ তৈরি হলেও ডায়িং ও নিটিং সেকশনের বাস্তব অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। ছাত্রজীবনে একাধিক টিউশন করানো এবং শিক্ষক বাবা–মায়ের অনুপ্রেরণায় ধীরে ধীরে শিক্ষকতার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় তাঁর।
স্নাতক শেষে নিটারে কিছু সময় শিক্ষকতা করার পর বুটেক্সে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের সুযোগ পেলে তাঁর আনন্দের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ভাইভা বোর্ডে শুরুতে কিছুটা সংকোচ থাকলেও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সব ধাপ অতিক্রম করেন তিনি। ভবিষ্যতে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্সে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণা করার পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
৪৫তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
প্রভাষক, ফেব্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
বুটেক্সে তাঁর ছাত্রজীবন শুরু হয় আত্মবিশ্বাস ও শেখার প্রবল আগ্রহ নিয়ে। প্রথম সেমিস্টারের ফলাফল হাতে পেয়ে তিনি বুঝতে পারেন—ধারাবাহিক ও সুশৃঙ্খল প্রচেষ্টাই ভালো ফলাফলের মূল চাবিকাঠি। তিনি নিজেকে কখনোই অসাধারণ মনে করেননি; বরং নিয়মিত ও মধ্যম মাত্রার প্রচেষ্টাকেই সাফল্যের পথ বলে বিশ্বাস করতেন।
করোনা মহামারির সময় কিছুটা বাধা এলেও ধৈর্য ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি পুনরায় কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জন করেন। একই ক্যাম্পাসে শিক্ষক হিসেবে ফিরে আসা তাঁর কাছে বিস্ময় ও কৃতজ্ঞতার এক বিশেষ অনুভূতি। ভবিষ্যতে শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণায় আরও গভীরভাবে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। তবে শিক্ষক সংকটের কারণে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া কঠিন বলেও জানান।
৪৪তম ব্যাচের প্রাক্তন শিক্ষার্থী
প্রভাষক, ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
প্রাক্তন শিক্ষার্থী থেকে একই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করাটা তাঁর জন্য এক অনন্য অভিজ্ঞতা। উচ্চমাধ্যমিক শেষে মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা থাকলেও কাঙ্ক্ষিত ফল না পাওয়ায় তিনি বুটেক্সে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার শুরু থেকেই ধারাবাহিক উৎকর্ষের মাধ্যমে বিভাগে শীর্ষস্থান ধরে রাখেন তিনি।
স্নাতকোত্তর ছাড়া শিক্ষক নিয়োগের সুযোগ সীমিত থাকলেও আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতা তাঁকে আরও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। বুটেক্সে শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে প্রিয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসাটিকে তিনি বিশেষ সম্মান হিসেবে দেখেন।
স্নাতকোত্তর ছাড়াই শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তকে তিনি বুটেক্স প্রশাসনের শিক্ষার্থী–কেন্দ্রিক ও দূরদর্শী উদ্যোগ হিসেবে প্রশংসা করেন। ভবিষ্যতে গবেষণাবান্ধব পরিবেশ ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে দেশের কেমিক্যাল সেক্টরে অবদান রাখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।