চীনের ইউনান প্রদেশে অনুষ্ঠিত বোয়াও এশিয়া বার্ষিক সম্মেলন ২০২৫-এ যোগ দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। সম্মেলনের ফাঁকে তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাইডলাইন বৈঠকে অংশ নিয়েছেন, যেখানে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়, কৃষি ও খাদ্য রপ্তানি, রোহিঙ্গা সংকট, রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এবং গণতন্ত্রের উত্তরণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার এই বৈঠকগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রফেসর ইউনূসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় চীনের স্টেট কাউন্সিলের এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রিমিয়ার ডিং জুয়েশিয়াং-এর সঙ্গে। এই বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা হয়।
এছাড়াও শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের বিষয়টি আলোচনায় গুরুত্ব পায়। বাংলাদেশের তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য চীনা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, গবেষণার ক্ষেত্র সম্প্রসারণ এবং দ্বিপাক্ষিক বৃত্তি কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন এবং সংকট সমাধানে চীনের সক্রিয় ভূমিকার আহ্বান জানান। এ বিষয়ে ভাইস প্রিমিয়ার ডিং জুয়েশিয়াং আশ্বাস দেন যে, চীন রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য কূটনৈতিকভাবে কাজ করে যাবে।
তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশ ও চীন দীর্ঘদিনের বন্ধুপ্রতীম দেশ। আমরা একসঙ্গে কাজ করতে চাই এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।”
চীনের এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান চেন হুয়াইয়ু-এর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশে চীনা কারখানা স্থানান্তর এবং বিনিয়োগের নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিল্পখাতে চীনা অর্থায়নের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়। এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান জানান, বাংলাদেশের টেকসই সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যাংক বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ ও সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
প্রফেসর ইউনূস জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মহাপরিচালক কু ডংইউ-এর সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। এই বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে চীনে শাকসবজি ও ফল রপ্তানি সহজ করার বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়।
প্রফেসর ইউনূস ফল ও সবজি সংরক্ষণ, আধুনিক প্রক্রিয়াকরণ ও উন্নত প্যাকেজিং ব্যবস্থার জন্য কারিগরি সহায়তা চান। এ প্রসঙ্গে মহাপরিচালক কু ডংইউ বলেন, “আমরা ম্যাচমেকার হিসেবে কাজ করব। চীনা বাজারে বাংলাদেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়াতে নতুন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে চাই।”
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব ও বোয়াও ফোরামের চেয়ারম্যান বান কি মুন-এর সঙ্গে বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নির্বিঘ্ন উত্তরণ নিয়ে আলোচনা করেন।
প্রফেসর ইউনূস বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে বলেন, “গণতন্ত্রের বিকাশ এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
বান কি মুন বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, “বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। প্রফেসর ইউনূসের নেতৃত্ব প্রশংসনীয় এবং বাংলাদেশের উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।”
তিনি আরও বলেন, “দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন, যাতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।”
রাশিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি ওভারচুক-এর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ-রাশিয়া দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উঠে আসে:
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনার অগ্রগতি
রাশিয়া থেকে বাংলাদেশে গম ও সার আমদানি
বাংলাদেশে গ্যাজপ্রমের গ্যাস অনুসন্ধানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
উপ-প্রধানমন্ত্রী ওভারচুক জানান, “রাশিয়া দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দিতে চায়। আরও বেশি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী রাশিয়ায় উচ্চশিক্ষার সুযোগ পাক, এটি আমরা নিশ্চিত করতে চাই।”
চীনের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর উ শিয়াওলিং ওরফে মাদাম উ-এর সঙ্গে বৈঠকে দারিদ্র্য বিমোচনে ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা হয়।
তিনি বলেন, “যদিও চীন ও বাংলাদেশ দারিদ্র্যের স্তরে ভিন্ন অবস্থানে রয়েছে, তবুও গ্রামীণ ব্যাংকের নীতি চীনা জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা এনে দিয়েছে।”
বৈঠকে সংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি ও ম্যানেজমেন্ট স্কুলের ডিন প্রফেসর ঝু সুফেং উপস্থিত ছিলেন এবং তিনি প্রফেসর ইউনূসকে সংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান।
গত ২৭ মার্চ “বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া বার্ষিক কনফারেন্স ২০২৫”-এ প্রফেসর ইউনূস ভাষণ প্রদান করেন।
ভাষণে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করছে। টেকসই প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য আঞ্চলিক সহযোগিতা অপরিহার্য।”
প্রধান উপদেষ্টা চার দিনের সফর শেষে আগামী ২৯ মার্চ দেশে ফিরবেন।