ভারতের বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়া জেলার তেতগামা গ্রামে ঘটে গেছে এমন এক বিভীষিকাময় ঘটনা, যা ২০২৫ সালেও ধর্মীয় কুসংস্কার ও কালো জাদু বিশ্বাস যে কতটা প্রাণঘাতী হতে পারে, তা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। ডাইনি বিদ্যার অভিযোগ তুলে একই পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে পিটিয়ে ও জীবন্ত পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছে উত্তেজিত জনতা। সোমবার (৭ জুলাই) সকালে স্থানীয় জলাশয়ের পাড় থেকে আধপোড়া দেহগুলি উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহতরা হলেন—বাবুলাল ওঁরাও, তার স্ত্রী সীতা দেবী, মা কাতো মোসামত, ছেলে মনজিৎ ওঁরাও এবং পরিবারের পুত্রবধূ রানি দেবী। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, রোববার গভীর রাতে প্রায় ২৫০ জন গ্রামবাসী সংঘবদ্ধভাবে ওই পরিবারটির ওপর চড়াও হয়। নিহতদের আরেক সন্তান সোনু ওঁরাও জানান, রাত তিনটার দিকে পরিবারের সবাই যখন ঘুমিয়ে ছিলেন, তখন জনতা হঠাৎ চিৎকার করতে করতে বাড়িতে ঢুকে তাদের ঘর থেকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়।
এরপর পুকুরপাড়ে নিয়ে পাঁচজনকে একে একে নির্মমভাবে লাঠি, রড, বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তীব্র চিৎকার, আগুনের লেলিহান শিখা আর আতঙ্কে কাঁপতে থাকা পরিবেশে নৃশংসতার এমন উৎসব রাতের আঁধার ছিন্ন করে গোটা গ্রামকে স্তব্ধ করে দেয়।
এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল সম্প্রতি একই গ্রামে এক শিশুর মৃত্যু এবং আরেক শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়া। এই ঘটনার পর গ্রামের এক তান্ত্রিক, নকুল ওঁরাও, দাবি করেন—নিহত পরিবারের সীতা দেবী ও কাতো মোসামত কালা জাদু ও ডাইনি বিদ্যায় পারদর্শী এবং তারাই এসবের জন্য দায়ী। এই বক্তব্যের পর উত্তেজিত জনতা দাবি তোলে, তারা যেন অসুস্থ শিশুটিকে সারিয়ে তোলে। যখন তা সম্ভব হয়নি, তখনই এক ধরনের সম্মিলিত ‘শাস্তি’র নামে তাদের হত্যা করে জনতা।
স্থানীয় পুলিশের ডিআইজি প্রমোদ কুমার মণ্ডল জানিয়েছেন, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আরও অনেককে শনাক্ত করে গ্রেফতার অভিযান চলছে। তিনি বলেন, “ঘটনাটি শুধু নৃশংস নয়, চরম লজ্জার। আধুনিক ভারতের এই যুগে দাঁড়িয়েও এই রকম কুসংস্কার ও হিংসার প্রকাশ সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন।”
ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই পূর্ণিয়ার পুলিশ সুপার সুইটি সাহরাওয়াত, এএসপি অলোক কুমার, ও একাধিক থানার অফিসার ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তদন্তে সহায়তার জন্য ফরেনসিক দল ও কুকুর বাহিনী মোতায়েন করা হয়। হত্যাকাণ্ড ঘিরে পুরো এলাকায় চাপা আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছে।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও এসেছে। বিহার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তেজস্বী যাদব বলেছেন, “নীতীশ কুমারের শাসনে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা যেখানে পৌঁছেছে, সেখানে ডাইনি অপবাদে একসাথে পাঁচজনকে পুড়িয়ে মারা হয়। এটি প্রমাণ করে সরকার কতটা ব্যর্থ।” তিনি কড়া ভাষায় প্রশাসনের উদাসীনতা ও জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণার অভাবকে দায়ী করেন।
এই ঘটনাটি শুধুই একটি গ্রাম বা পরিবারকে নয়, বরং পুরো সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০২৫ সালেও যেখানে মানুষ জাদুটোনা, তান্ত্রিকতা ও ডাইনিবিদ্যার মতো কুসংস্কারে বিশ্বাস করে এবং বিচার ব্যবস্থার পরিবর্তে গণহিংসাকে হাতিয়ার বানায়, সেখানে সামাজিক শিক্ষা, আইনি সচেতনতা ও প্রশাসনিক কড়াকড়ির জোরালো প্রয়োজন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।