এক মুখহীন মূর্তি, এক পরিচয়হীন নাম
হাঙ্গেরির রাজধানী বুদাপেস্ট। দানিউব নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে এক রহস্যময় ব্রোঞ্জ মূর্তি। হুডি পরা, চোখ-নাক-মুখহীন—এক আয়নামুখী মুখাবয়ব। মূর্তিটির পাশে খচিত বিটকয়েনের লোগো। এই ভাস্কর্যটি উৎসর্গ করা হয়েছে এক অচেনা সত্তার প্রতি, যাঁর নাম সাতোশি নাকামোতো।
আজও যাঁকে কেউ চেনেন না, কিন্তু যাঁর তৈরি করা ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েন বদলে দিয়েছে বিশ্বের অর্থনৈতিক কাঠামো।
—
🧠 জন্ম এক বিপ্লবের
২০০৮ সাল। বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দা। ঠিক সেই সময়, একটি নামহীন ইমেইল থেকে প্রকাশিত হয় এক শ্বেতপত্র—
“Bitcoin: A Peer-to-Peer Electronic Cash System”
লেখক—সাতোশি নাকামোতো।
এই শ্বেতপত্রে প্রথম প্রস্তাব আসে এমন এক মুদ্রার, যা চালিত হবে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছাড়াই। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির কাছে সরাসরি লেনদেন হবে, একেবারে স্বচ্ছ ও স্বতন্ত্র এক প্রযুক্তির মাধ্যমে—ব্লকচেইন।
—
⛓️ ব্লকচেইনের ভিত্তিপ্রস্তর
২০০৯ সালে চালু হয় প্রথম বিটকয়েন ব্লক—‘জেনেসিস ব্লক’।
SHA-256 অ্যালগরিদমে নির্মিত এই সিস্টেম এতটাই নিরাপদ যে বিটকয়েন নিজে কখনোই হ্যাক হয়নি, যদিও কিছু এক্সচেঞ্জে হ্যাকিং হয়েছে।
প্রতিটি লেনদেনের রেকর্ড খোলামেলা, স্থায়ী এবং পরিবর্তন অযোগ্য। একটি নির্ভরযোগ্য, বিকেন্দ্রীকৃত ব্যাংকিং ব্যবস্থা—যেখানে কোনো রাষ্ট্র, কোম্পানি বা সংস্থা হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
—
💰 এক ট্রিলিয়নের রাজত্ব
আজ বিটকয়েনের বাজারমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠান যেমন টেসলা, মাইক্রোসফট বিটকয়েন গ্রহণ করছে। এল সালভাদরের মতো দেশ তো এটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতীয় মুদ্রা হিসেবে।
তবে বিটকয়েনের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতাও এখানেই—কোনো নিয়ন্ত্রক নেই মানেই, ভুল লেনদেন ফিরিয়ে আনার সুযোগও নেই।
—
🤐 নীরব স্রষ্টা, রহস্যময় অন্তর্ধান
২০১১ সালের পর সাতোশি নাকামোতো আর প্রকাশ্যে কিছু লেখেননি। বিটকয়েন কমিউনিটি থেকে নিঃশব্দে সরে যান তিনি। কে তিনি? একক কোনো ব্যক্তি? না কি একদল প্রোগ্রামার?
বিভিন্ন সময়ে তার পরিচয়ে উঠে এসেছে—হ্যাল ফিনি, নিক জ্যাবো, ক্রেইগ রাইট কিংবা দোরিয়ান নাকামোতোর নাম। কিন্তু কোনো পরিচয়ই চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি।
—
💼 অদৃশ্য ধনকুবের
বিশ্বাস করা কঠিন হলেও সত্য—এই ‘অজ্ঞাতনামা’ মানুষটি এখন বিশ্বের ১২তম ধনী। তার নামে থাকা বিটকয়েন ভলেটে রয়েছে প্রায় ১২৮.৯২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ মুদ্রা।
কিন্তু তার কোনও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই, নেই প্রকাশ্য অস্তিত্ব—শুধু আছে তার সৃষ্টি, আর কোটি মানুষের বিশ্বাস।
—
🕵️ পরিচয় গোপনের রহস্য
বিশ্লেষকরা বলছেন, সাতোশির পরিচয় গোপন রাখার পেছনে একটি বড় কারণ হতে পারে নিরাপত্তা। ইতিহাস সাক্ষী, যারা মার্কিন ডলারের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
এফবিআই ইতিমধ্যেই ক্রিপ্টোকারেন্সিকে ‘ফেডারেল চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বিবেচনা করছে।
—
🌐 প্রযুক্তি না কি দর্শন?
চার হাজার দিনের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে বিটকয়েনের সূচনা থেকে।
আজ এটি শুধু একটি প্রযুক্তি নয়—এ এক দার্শনিক আন্দোলন, এক নতুন আর্থিক স্বাধীনতার প্রতীক।
এবং সাতোশি নাকামোতো?
তিনি রয়ে গেছেন একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় রহস্য হিসেবে।