নোটিশ:

হাসিনা, বাশারের মতো পতন হতে পারে মিয়ানমার সামরিক জান্তার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
  • আপডেট সময় শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২৫
  • ৮৫ বার দেখা হয়েছে
মিয়ানমার সামরিক জান্তা পতন

সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। সেনাবাহিনীতে পক্ষ বদলের মতো অস্বাভাবিক ঘটনাও ঘটছে। জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে দেশের মোট ভূখণ্ডের মাত্র এক চতুর্থাংশেরও কম। তদুপরি, নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলিও ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ অবস্থায় রয়েছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর রাজধানী নেপিদোর দিকে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যদি বিদ্রোহীদের শক্তি রাজধানীর দিকে ছড়িয়ে পড়ে, তবে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পরিণতি বাংলাদেশের শেখ হাসিনা এবং  সিরিয়ার বাশার আল আসাদের শাসনের মতো হতে পারে

মিয়ানমারে সামরিক জান্তা ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করার পর থেকে দেশটি রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংস সংঘর্ষ এবং ব্যাপক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। সামরিক জান্তা গত দুই বছরে দেশের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রচেষ্টা চালালেও অভ্যন্তরীণ বিরোধ এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর শক্তিশালী প্রতিরোধের কারণে এটি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। এই প্রতিবেদনটি সামরিক জান্তার পতনের সম্ভাবনা বিশ্লেষণ করছে এবং অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক উপাদানগুলোর বিশদ বিবরণ প্রদান করছে যা জান্তার পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।

 

১. সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধ: ঐক্যবদ্ধ বিরোধিতা

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বড় ধরনের প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। এই প্রতিরোধটি মূলত বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী থেকে আসছে, যারা দীর্ঘ সময় ধরে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছে। যেমন, কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (KNLA), কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (KIA), শান স্টেট আর্মি (SSA), আরাকান আর্মি (AA) সহ বিভিন্ন গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীগুলি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা গুরুত্বপূর্ণ শহর ও সীমান্ত এলাকা দখল করেছে।

“থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স” গঠিত হওয়া

অক্টোবর ২০২৩ সালে “থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স” নামে একটি জোট গঠিত হয়, যা মিয়ানমারের প্রধান জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী, যেমন আরাকান আর্মি (AA), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (MNDAA), এবং তা’ং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (TNLA) এর সমন্বয়ে তৈরি হয়। এই জোট সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলছে, যা জান্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি।

সম্প্রতি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর আঞ্চলিক অর্জন

এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি সম্প্রতি মিয়ানমারের কাচিন, শান, এবং আরাকান রাজ্যে কৌশলগত শহরগুলো দখল করেছে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তারা আরাকান অঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে, যা সামরিক জান্তার জন্য একটি বড় আঘাত। এর ফলে, সামরিক বাহিনীকে এই অঞ্চলে তাদের দখল রাখতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে, এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা তাদের নিজস্ব সেনাঘাঁটি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে।

২. সামরিক জান্তার গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণের দুর্বলতা

যদিও সামরিক জান্তা মিয়ানমারের বৃহত্তর শহর এবং শহরতলি এলাকাগুলোতে তার প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, তবুও তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং সেনাদের মধ্যে মনোবলের অভাবও ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়।

প্রধান শহর এবং অর্থনৈতিক কেন্দ্র হারানো

যানবাহন ও অবকাঠামো ভাঙচুরের কারণে জান্তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকাগুলির মধ্যে যাতায়াত ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে। ইয়াংগন (মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর) এবং নায়পিদো (রাজধানী) এর ওপর সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সেনাবাহিনী কিছু শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে, এবং বিদ্রোহীরা নতুন অঞ্চল দখল করছে।

৩. আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং সংঘাত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজর কেড়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো যেমন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন জান্তার ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তবে চীন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের প্রতি দীর্ঘকাল ধরে সমর্থন জানালেও এখন পরিস্থিতি পরিবর্তনের বিষয়ে চিন্তাভাবনা করছে।

চীনের পরিবর্তিত অবস্থান

চীন কখনো মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গেই ঐক্যবদ্ধ ছিল, কিন্তু এখন মিয়ানমারের দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার কারণে চীন তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে পারে। চীনের জন্য মিয়ানমারে স্থিতিশীলতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটি Belt and Road Initiative (BRI) এর অধীনে মিয়ানমারে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। যদি সামরিক জান্তা পতন হয়, তবে চীনের প্রকল্পগুলো বিপর্যস্ত হতে পারে, ফলে তারা আরও মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা পালন করতে পারে।

আসিয়ান সংকট

আসিয়ান (ASEAN) দেশগুলো মিয়ানমারের সংকটে মৌলিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে, কিন্তু তাদের নিষ্ক্রিয়তা সামরিক জান্তার প্রভাব খর্ব করতে পারেনি। আসিয়ান সামরিক জান্তা এবং বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মধ্যস্থতার চেষ্টা করলেও তা তেমন কার্যকর হয়নি।

৪. মানবিক সংকট: শরণার্থী প্রবাহ এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে অস্থিরতা

মিয়ানমারে সংঘাতের ফলস্বরূপ হাজার হাজার শরণার্থী প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রবাহিত হচ্ছে, এবং এটির ফলে সীমান্তে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে যে অত্যাচার চলছে, তা বৈশ্বিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

রোহিঙ্গা সংকট

রোহিঙ্গা মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর দমনপীড়ন ২০১৭ সালে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, যার ফলে ৭০০,০০০ এর বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল । এখনও পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ আশ্রয় ও সহায়তা সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে, এবং মিয়ানমারে চলমান সহিংসতার কারণে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

মানবপাচার ও সীমান্তের অস্থিরতা

সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যাওয়ায়, মানবপাচারের হার বেড়ে গেছে। শরণার্থীরা বিপদজনক পথ অবলম্বন করে দেশত্যাগ করছে, এবং এই শরণার্থীদের একাংশের ক্ষেত্রে পাচারকারীরা তাদের কাজে লাগাচ্ছে।

৫. সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি: সামরিক জান্তার পতন

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার পতন ক্রমশ বাস্তবসম্মত হয়ে উঠছে, তবে এর পরবর্তী পরিস্থিতি অনিশ্চিত। কিছু সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিম্নরূপ হতে পারে:

  • গৃহযুদ্ধ এবং দেশভাগ: জান্তার পতনের পর মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে ধাবিত হতে পারে, যেখানে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী ক্ষমতার জন্য লড়াই করবে এবং দেশটি জাতিগত ভিত্তিতে বিভক্ত হতে পারে।
  • আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ: যদি জান্তার পতন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে এবং সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পায়, তবে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলি, বিশেষ করে জাতিসংঘ বা ASEAN, হস্তক্ষেপ করতে পারে।
  • কূটনৈতিক সমাধান: যদি বিরোধী গোষ্ঠীগুলি এবং সামরিক জান্তা আলোচনার টেবিলে বসে, তবে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হতে পারে, যদিও এটির জন্য যথেষ্ট রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন আর সম্ভাবনা খুব কম।

 মিয়ানমারের ভবিষ্যত:

মিয়ানমার এখন একটি সংকটময় অবস্থায় রয়েছে, যেখানে সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণ হ্রাস পাচ্ছে এবং জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধ শক্তিশালী হচ্ছে। জান্তার পতন আসন্ন হলেও, এর পরবর্তী পরিস্থিতি অতীব জটিল হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলি, মিয়ানমারের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর সর্বশেষ নিউজ পড়তে ক্লিক করুন: সর্বশেষ
  • দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর ফেসবুক পেজটি ফলো করুন: dailysabasbd

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT