মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা. ) মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য উদাহরণ। মানবজাতি হলো মহান আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টির সেরা নিদর্শন। মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। প্রথম মানব ও মানবী হজরত আদম (আ.) এবং হজরত হাওয়া (আ.) থেকে সমগ্র মানবজাতির উৎপত্তি। আল্লাহ প্রদত্ত অধিকারগুলোকেই মানবাধিকার বলা হয়, যেমন—জন্মগ্রহণের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকার, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার এবং স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকার। এসব অধিকার প্রত্যেক মানুষের জন্মগত। এগুলোর ব্যত্যয় হলে তা আল্লাহর বিধানের বিপরীত এবং অন্যায়।
ইসলামে মানবাধিকার
ইসলামে মানুষ আল্লাহর খলিফা হিসেবে সম্মানিত। মানুষের মর্যাদা রক্ষা এবং তাদের অধিকার সুরক্ষার জন্যই আল্লাহ নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং শরিয়তি বিধান দিয়েছেন। ইসলামি শরিয়তের মূল উদ্দেশ্য পাঁচটি বিষয়কে সুরক্ষা দেওয়া: জীবন, সম্পদ, বংশ, জ্ঞান এবং ধর্ম। মূলত, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ইসলামের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও রাসূল (সা.)-এর দৃষ্টান্ত
হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অতুলনীয় উদাহরণ স্থাপন করেছেন। তিনি এমন এক যুগে জন্মগ্রহণ করেন, যখন সমাজ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। “আইয়ামে জাহিলিয়াত” নামে পরিচিত সেই সময়ে মানুষ ছিল নৈতিকতাবিহীন। কন্যাশিশুকে জীবন্ত মাটিচাপা দেওয়া, দাসপ্রথা এবং সামাজিক অন্যায়-অবিচার ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। রাসূল (সা.) এই অমানবিক প্রথাগুলোকে ধ্বংস করে মানবতার মশাল জ্বালান। ইসলামে সব ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং এসবকে ‘কবিরা গুনাহ’ বা বড় পাপ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা
ইসলামের শিক্ষা হলো, সব মানুষ একই উপাদানে সৃষ্ট এবং এক পিতা-মাতার সন্তান। কারও গায়ের রং, জাতি বা বংশগত পরিচয় দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারণ করা যাবে না। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, “কবর বা পরকালে সবাইকে একই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে।” সুতরাং, ইসলামে সব মানুষের অধিকার সমান।
বেঁচে থাকার অধিকার
আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন, “যদি কেউ অন্যায়ভাবে একজনকে হত্যা করে, তবে সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর কেউ কারও জীবন রক্ষা করলে, সে যেন পুরো মানবজাতির জীবন রক্ষা করল।” (সুরা: মায়িদাহ, আয়াত: ৩২)। এর মাধ্যমে ইসলামে বেঁচে থাকার অধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
সম্পত্তি ও জীবিকা রক্ষার অধিকার
কোরআনে বলা হয়েছে, “তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না।” (সুরা নিসা, আয়াত: ২৯)। ইসলামে নারী ও পুরুষ উভয়ের অধিকার সমান। সম্পত্তির ক্ষেত্রে কারও প্রতি অন্যায় করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
শিক্ষার অধিকার
ইসলামে জ্ঞান অর্জন নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য ফরজ। রাসূল (সা.) বলেছেন, “প্রত্যেক মুসলিমের জন্য জ্ঞান অর্জন বাধ্যতামূলক।” (ইবনে মাজাহ)। ইসলামে মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ তা মানুষের জ্ঞান ও বিবেককে ধ্বংস করে।
বংশ ও মর্যাদার অধিকার
বৈবাহিক সম্পর্ক এবং দাম্পত্য জীবনের মর্যাদা রক্ষা ইসলামের একটি মৌলিক দিক। এখানে নারী-পুরুষ উভয়ের মতপ্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার রয়েছে। পাত্র বা পাত্রী নির্বাচনে স্বাধীনতার বিষয়টিও ইসলামে বিশেষভাবে সুরক্ষিত।
ধর্ম পালনের অধিকার
কোরআনে বলা হয়েছে, “যে ব্যক্তি ভালো কাজ করবে, সে নারী হোক বা পুরুষ, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” (সুরা: মুমিন, আয়াত: ৪০)। ইসলামে সবার জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে।
উপসংহার
ইসলাম মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক অনন্য নজির। এটি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত জীবনে নয়, সামাজিক ও বৈশ্বিক পরিসরেও মানবতার সুরক্ষা নিশ্চিত করে। নারী, শিশু, অসহায় ব্যক্তি এবং বৃদ্ধদের অধিকারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলামে মানবাধিকার রক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলিমের ওপর অর্পিত। রাসূল (সা.)-এর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের উচিত মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা।
Leave a Reply