মনমোহন সিং, ভারতের ১৩তম প্রধানমন্ত্রী, ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের গাহ নামক একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এই গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যান তিনি। তিনি আর কখনও জন্মভূমিতে ফিরে আসেননি, তবে তার দানশীলতা এবং গ্রামবাসীদের ভালোবাসা তার স্মৃতিকে এখনো জীবন্ত রেখেছে।
গাহ: একটি গ্রাম যেখানে স্মৃতিগুলো এখনও জীবিত
পাকিস্তানের চকওয়ালের কাছে অবস্থিত গাহ গ্রামটি সময়ের সঙ্গে প্রায় হারিয়ে গেলেও মনমোহন সিংয়ের নাম সেখানে এক গর্বের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। দেশভাগের পরে তিনি আর তার জন্মভূমি দেখতে আসেননি, তবে তার শৈশবের স্মৃতিগুলো গ্রামবাসীরা সংরক্ষণ করেছেন।
সিংয়ের গাহ গ্রাম নিয়ে অনুভূতিগুলো ছিল মিশ্র।
পাঞ্জাবের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী মনপ্রীত সিং বাদল যখন তাকে প্রশ্ন করেন কেন তিনি কখনও জন্মস্থান গাহ-এ ফিরে যাননি, তখন সিং বলেছিলেন, “ইয়াদান বড়েয়ান তলখ হুন”—স্মৃতিগুলো অনেক তিক্ত।
দেশভাগের সময় গাহ গ্রাম ব্যাপক সহিংসতার শিকার হয়েছিল। এই স্মৃতিগুলো সিংয়ের হৃদয়ে এমন ক্ষত তৈরি করেছিল যা কখনও পুরোপুরি সারেনি।
২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর, ৯২ বছর বয়সে নয়াদিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেস-এ মনমোহন সিং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
২০০৪ সালে সিং যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন গাহ গ্রামের মানুষ এমনভাবে উদযাপন করেছিল যেন তাদেরই কেউ এই সাফল্য অর্জন করেছে।
তারা স্কুলের পুরোনো রেকর্ড খুঁজে দেখেছিল যেখানে সিং ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন। নথিগুলো বলেছিল, তিনি ছিলেন পরিশ্রমী ছাত্র, সবসময় সেরা দশের মধ্যে থাকতেন। তার বাবা গুরমুখ সিং ছিলেন একজন দোকানদার, আর সিং কেরোসিন বাতির আলোয় পড়াশোনা করতেন।
কয়েক বছর আগে, শিখ ঐতিহ্যের ইতিহাসবিদ শাহিদ শাব্বির গাহ গ্রামে গিয়েছিলেন সিংয়ের সাথে গ্রামটির সংযোগ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে। গ্রামবাসীরা তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিল এবং সিংয়ের শৈশবের গল্প শেয়ার করেছিল। শাব্বির বলেছিলেন, “গ্রামটি এখনও পুরোনো ঐতিহ্য ধরে রেখেছে, এবং এখানকার বাসিন্দারা সিংয়ের স্মৃতিকে গভীরভাবে লালন করেন।”
গ্রামের লোকেরা এখনও আশা করত যে তাদের ‘মোহনা’, যেমন তারা তাকে ডাকত, একদিন গ্রামে ফিরে আসবেন।
সিংয়ের যে স্কুলে তিনি পড়াশোনা করতেন, সেটি এখন একটি মধ্যম বিদ্যালয়। আশেপাশের গ্রামের শিশুরা এখানে পড়াশোনা করে। শিক্ষকরা সিংয়ের গল্প ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন, জানান যে সাধারণ জীবন থেকেও মহানত্ব অর্জন সম্ভব।
স্কুলের অধ্যক্ষ সিংয়ের নথিগুলো দেখিয়ে বলেছিলেন, “তিনি সবসময় সেরা দশে ছিলেন।”
তার শৈশবের বন্ধুরা এখনও তাকে গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করে। তাদের মধ্যে একজন, মুহাম্মদ আশরাফ, তাদের স্কুল জীবনের কথা মনে করে বলেছিলেন: “তিনি আমার জন্য এখনও মোহনা।”
অন্য বন্ধু রাজা মোহাম্মদ আলী ২০০৮ সালে দিল্লিতে সিংয়ের সাথে দেখা করতে পেরেছিলেন। তিনি গাহ গ্রামের মাটি এবং পানি উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে তাদের এই পুনর্মিলন খুব সংক্ষিপ্ত ছিল; দুই বছর পর আলী মারা যান।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা সত্ত্বেও, গাহ গ্রামটি একটি বিরল ঐতিহ্য ও সৌহার্দ্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২০০৫ সালে, পাকিস্তান সরকার গাহ গ্রামটিকে একটি মডেল গ্রামে পরিণত করার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম সিংয়ের নামে রাখার পরিকল্পনা করেছিল। যদিও নাম পরিবর্তন হয়নি, সিং নিজে থেকে গ্রামের জন্য অনেক কিছু করেছিলেন—একটি পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা, সৌরশক্তি চালিত আলো, এবং একটি মধ্যম বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।
যদিও তিনি আর কখনও ফিরে যাননি, গ্রামবাসীরা এখনও তার স্মৃতিকে সজীব রেখেছে।
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড
Leave a Reply