একটি পাসপোর্টের শক্তি নির্ধারিত হয় বিভিন্ন বিষয়ের উপর, যেমন জিডিপি, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং অভিবাসন প্রবণতা, যা বৈশ্বিক চলাচলের ধারা গঠন করে।
প্রতিদিন, লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। কিন্তু অনেকের জন্য, তাদের পাসপোর্ট সেই ধরনের স্বাধীনতা দেয় না।
জানুয়ারিতে, হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স এবং আর্টন ক্যাপিটাল তাদের বার্ষিক পাসপোর্ট সূচক প্রকাশ করে, যা পাসপোর্টের আপেক্ষিক শক্তি মূল্যায়ন করে—কত দূর পর্যন্ত এটি ভিসার প্রয়োজন ছাড়াই আপনাকে নিয়ে যেতে পারে তা বিবেচনা করে।
প্রতি বছর এই ফলাফল একটি পরিচিত বিতর্ক উসকে দেয়: কেন কিছু পাসপোর্ট বিশ্বভ্রমণের চাবিকাঠির মতো কাজ করে, আর কিছু যেন তালাবদ্ধ দরজার মতো?
উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুর এবং জাপানের পাসপোর্টধারীরা ১৯০টিরও বেশি দেশে খুব বেশি ঝামেলা ছাড়াই প্রবেশ করতে পারে। অন্যদিকে, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক এবং পাকিস্তানের নাগরিকদের জন্য তাদের পাসপোর্ট প্রায়শই সন্দেহের চোখে দেখা হয় এবং বেশিরভাগ গন্তব্যের জন্য ভিসা প্রয়োজন হয়।
হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের ইস্তানবুল প্রতিনিধি বুরাক ডেমিরেল জানান, এই সূচকের তথ্য আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংস্থা (IATA) থেকে নেওয়া হয় এবং এটি তাদের নিজস্ব গবেষণা ও উন্মুক্ত উৎসের তথ্যের (যেমন সংবাদ প্রতিবেদন) মাধ্যমে সমৃদ্ধ করা হয়।
কিন্তু অনেক ভ্রমণকারীর জন্য—বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথ থেকে আসা ব্যক্তিদের জন্য—এই র্যাংকিং একটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয় না: কেন কিছু পাসপোর্ট বেশি সুযোগ দেয়, আর কিছু কম?
দুর্ভাগ্যবশত, এই প্রশ্নের সরল উত্তর নেই; বরং এটি একটি জটিল ধাঁধার অংশ।
একটি পাসপোর্টের অবস্থান নির্ভর করে তার বাহকের জন্য কতগুলো দেশে ভিসা ছাড়াই প্রবেশের সুযোগ রয়েছে তার উপর। ইলেকট্রনিক ও অন-অ্যারাইভাল ভিসাও অন্তর্ভুক্ত হয়, তবে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অবস্থা হলো পুরোপুরি ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার।
গবেষকরা যারা চলাচল ও অভিবাসনের ওপর কাজ করেন, তারা কিছু বিষয় চিহ্নিত করেছেন যা একটি পাসপোর্টের শক্তি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ, জনসংখ্যার আকার, এমনকি ভিসার সময়সীমা অতিক্রম করার হার—এসবই গুরুত্বপূর্ণ।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ উগুর আলতুনডাল বলেন, ‘‘যদি তথ্য দেখা যায়, গড়ে বেশি জিডিপি সম্পন্ন দেশগুলোর ভিসা স্কোরও বেশি, কারণ তাদের নাগরিকদের অপ্রয়োজনীয় অভিবাসনের ঝুঁকি কম থাকে, যা অন্য দেশগুলোর পক্ষে ভিসা সহজ করার ক্ষেত্রে অনুকূল হয়।’’
গত এক দশকে অনেক দেশ ভিসা বিধিনিষেধ শিথিল করেছে বা আন্তর্জাতিক ভ্রমণকে সহজ করতে ভিসার প্রয়োজনীয়তা কমিয়েছে।
তবে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষের জন্য এটি তেমন কোনও পরিবর্তন আনেনি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভিসার প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র একটি আমলাতান্ত্রিক ঝামেলা নয়; এটি গ্লোবাল সাউথের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক চলাচলের পথে বড় বাধা হতে পারে।
একজন ব্যক্তি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কী করতে পারবে, তা নির্ধারিত হয় মূলত তার পাসপোর্টের মাধ্যমে।
উদাহরণস্বরূপ, একজন নাইজেরিয়ান কম্পিউটার প্রকৌশলী যদি একটি ফরাসি কোম্পানিতে চাকরি পান, তবুও এটি নিশ্চিত নয় যে তিনি সেখানে কাজ করার ভিসা পাবেন।
২০২৩ সালে, বাংলাদেশ, ঘানা, মালি, পাকিস্তান ও সেনেগালের শেনজেন ভিসা আবেদনের ৪১ থেকে ৫০ শতাংশ প্রত্যাখ্যান করা হয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা বা আভ্যন্তরীণ সংঘাতও একটি দেশের পাসপোর্টের শক্তি দুর্বল করতে পারে।
আলতুনডাল বলেন, ‘‘যদি কোনও দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বা গৃহযুদ্ধ থাকে এবং জনসংখ্যা বেশি হয়, তাহলে শরণার্থী হওয়ার বা অননুমোদিত অভিবাসীর সংখ্যা বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।’’
কিন্তু পাসপোর্ট র্যাংকিং সব সময় একই যুক্তিতে চলে না।
উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তান হেনলি ইনডেক্সে ৯৬তম স্থানে রয়েছে, যেখানে এটি দীর্ঘদিন ধরেই অবস্থান করছে। কিন্তু এর মাথাপিছু জিডিপি, মানব উন্নয়ন সূচক (HDI) এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার অবস্থা বুর্কিনা ফাসো, চাদ, সিয়েরা লিওন বা সুদানের চেয়ে ভালো। তবু, এসব দেশের পাসপোর্ট আরও বেশি গন্তব্যে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়।
এর কারণ, বুর্কিনা ফাসো ও চাদ অন্যান্য আফ্রিকান দেশের সঙ্গে বাণিজ্য, কূটনৈতিক ও ভিসামুক্ত চুক্তি করেছে, যা তাদের পাসপোর্টের শক্তি বাড়িয়েছে।
আধুনিক পাসপোর্টের ধারণা ২০শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আসে, বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ থেকে।
“আমরা আজ যে পাসপোর্ট বহন করি, তা মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল, যখন আন্তর্জাতিক সংঘাতের কারণে নাশকতা ও গুপ্তচরবৃত্তির উদ্বেগ ছিল,” বলেন লেখক প্যাট্রিক বিক্সবি।
তখন এটি জাতীয় সীমানা রক্ষা ও অভ্যন্তরীণ চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য তৈরি হয়েছিল, এবং এখনো সেই প্রভাব রয়ে গেছে।
সিরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান ও ভেনিজুয়েলার সংঘাত লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বাড়িয়েছে। কিন্তু সব শরণার্থীদের সমানভাবে দেখা হয় না।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২২ সালে রাশিয়ার আক্রমণের পর ৬.৮ মিলিয়নেরও বেশি ইউক্রেনীয় ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছেন। তা সত্ত্বেও, ইউক্রেনের পাসপোর্ট এখনো শক্তিশালী, যা ১৪৭টি গন্তব্যে ভিসামুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়।
অন্যদিকে, সিরিয়ানরা কঠোর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়।
উগুর আলতুনডাল বলেন, “ইউক্রেনের ক্ষেত্রে আমরা বর্ণবাদের প্রভাব দেখতে পাই। সংস্কৃতিগত নৈকট্য, ধর্ম, ভূগোল এবং রাজনৈতিক প্রভাব এখানে ভূমিকা রাখে।”
ইউরোপে কট্টর ডানপন্থী দলের উত্থান এবং পশ্চিমা দেশে অভিবাসনবিরোধী মনোভাব বাড়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞ বিক্সবি বলেন, “আন্তর্জাতিক ভ্রমণ ও অভিবাসনের যুগে, একজন ব্যক্তির ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই নির্ভর করে তার পাসপোর্টের উপর।”
সূত্র: টিআরটি ওয়ার্ল্ড