জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস শুক্রবার বাংলাদেশে চার দিনের সফরে এসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উদ্যোগে নেওয়া সংস্কার প্রক্রিয়ায় পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
বৃহস্পতিবার ঢাকায় পৌঁছানো জাতিসংঘ মহাসচিব শুক্রবার তেজগাঁওয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে তিনি ঢাকার সংস্কার কর্মসূচির প্রতি জাতিসংঘের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন এবং “বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত জনগোষ্ঠী” রোহিঙ্গাদের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “আমি সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করতে চাই। আমরা আপনার সংস্কারগুলোকে সমর্থন দিতে এখানে এসেছি। আমরা আপনাদের মঙ্গল কামনা করি। আমাদের পক্ষে যা করা সম্ভব, জানাবেন।”
গুতেরেস আশা প্রকাশ করেন, এই সংস্কার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের “বাস্তব রূপান্তর” নিশ্চিত করবে। তিনি স্বীকার করেন যে, “সংস্কারের প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে।”
রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতেই তিনি রমজান মাসে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন বলে জানান।
তিনি বলেন, “আমি এমন কোনো জনগোষ্ঠী দেখিনি, যারা এত নিপীড়নের শিকার। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভুলে যাচ্ছে।” রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কমে যাওয়ার বিষয়ে তিনি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
“সহায়তা কমানো একটা অপরাধ,” তিনি মন্তব্য করেন এবং যোগ করেন, পশ্চিমা দেশগুলো এখন প্রতিরক্ষা ব্যয় দ্বিগুণ করছে, অথচ বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
তিনি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের “অপরিসীম কৃতজ্ঞতা” প্রকাশ করেন এবং বলেন, “বাংলাদেশ রোহিঙ্গা জনগণের প্রতি অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছে।”
অধ্যাপক ইউনূস জাতিসংঘ মহাসচিবকে এই সংকটপূর্ণ সময়ে দেশটিতে সফর করার জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, “আপনি এর চেয়ে ভালো সময়ে আসতে পারতেন না। আপনার সফর কেবল রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও সময়োপযোগী।”
প্রধান উপদেষ্টা গুতেরেসকে বাংলাদেশের সংস্কার প্রক্রিয়ার অগ্রগতির কথা জানান। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে প্রায় ১০টি রাজনৈতিক দল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে তাদের মতামত জমা দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশে একমত হলে তারা জুলাই মাসে একটি “জুলাই সনদ” স্বাক্ষর করবে, যা হবে দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তর এবং রাজনৈতিক, বিচারিক, নির্বাচনী, প্রশাসনিক, দুর্নীতিবিরোধী ও পুলিশ সংস্কারের রূপরেখা।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো “সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ”-এ একমত হলে নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে, তবে যদি তারা “বৃহত্তর সংস্কার প্যাকেজ” চায়, তবে আগামী বছরের জুনে নির্বাচন হবে।
অধ্যাপক ইউনূস রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনে এবং এদিকে আশ্রিত ১২ লাখ শরণার্থীর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও মানবিক সহায়তা সংগ্রহে জাতিসংঘ মহাসচিবের সমর্থন কামনা করেন।
গুতেরেস আশ্বাস দিয়ে বলেন, “আমি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যথাসাধ্য করব এবং তাদের জন্য সমর্থন জোগাড়ে অগ্রাধিকার দেব।”
বৈঠকে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকারও প্রশংসা করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী বাহিনী আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের ভূমিকা অসাধারণ। বাংলাদেশ ন্যায়সংগত বিশ্ব গঠনে প্রথম সারিতে রয়েছে।”
গুতেরেস আরও বলেন, তার কাছে রোহিঙ্গারা “বিশেষ গুরুত্ব” বহন করে।
এছাড়াও, বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্ক, সার্কের অবস্থা এবং দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক ফোরাম পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টাও আলোচনায় উঠে আসে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে “আসিয়ান”-এর সদস্যপদ পেতে চায়।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ নেপাল ও ভুটানের জলবিদ্যুৎ কাজে লাগাতে এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে “সাউথ এশিয়া গ্রিড” তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা অর্থনীতির অবস্থা নিয়েও আলোচনা করেন। তিনি বলেন, তার সরকার একটি ভঙ্গুর অর্থনীতি, ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যাংকিং খাত, কমে যাওয়া রিজার্ভ এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠান উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। তবে এখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, রপ্তানি বাড়ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো অবস্থানে রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ আগামী বছর স্বল্পোন্নত দেশের (LDC) তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূস পূর্ববর্তী সরকারের নেতৃত্ব এবং তাদের ঘনিষ্ঠদের দ্বারা “১৬ বছরে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার” হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব তার দেশের বিপ্লবী দিনগুলোর কথা স্মরণ করে বলেন, “এটি আমাকে ১৯৭৪ সালের পর্তুগালের বিপ্লবী দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।”
এ সময় জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের প্রশংসা করেন অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, “তিনি চমৎকার কাজ করেছেন। তারা শেখ হাসিনা সরকারের দ্বারা সংঘটিত অপরাধগুলো নথিভুক্ত করেছেন। তাদের আরও কাজ করা উচিত।”
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার উচ্চ প্রতিনিধি ড. খলিলুর রহমান, এবং সিনিয়র সচিব লামিয়া মোর্শেদ।
জাতিসংঘের আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমা এবং জাতিসংঘের বাংলাদেশ আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইসও বৈঠকে অংশ নেন।