বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারানো ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলামের জানাজা আজ কুর্মিটোলা ঘাঁটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়। মঙ্গলবার (২২ জুলাই) দুপুর ১টা ৫ মিনিটে অনুষ্ঠিত এই জানাজায় উপস্থিত ছিলেন দেশের শীর্ষ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তারা। ছিলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধানসহ শহীদ পাইলটের পরিবারের সদস্যরা। ফিউনারেল প্যারেডের মাধ্যমে রাষ্ট্র পাইলট তৌকির ইসলামের আত্মত্যাগকে সম্মান জানায়।
গতকাল (২১ জুলাই) দুপুর ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করার কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি FT-7 BGI প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে। দুর্ঘটনার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বিমানটি ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে নিয়ে যেতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যান তরুণ পাইলট তৌকির ইসলাম। তিনি নিজের জীবন দিয়ে শত শত স্কুলশিক্ষার্থীর জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বিমানটি উত্তরার দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনের ওপর বিধ্বস্ত হয়। এতে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩১ জন নিহত এবং ১৭১ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যাদের অধিকাংশই শিক্ষার্থী।
পাইলট তৌকির ইসলাম ইজেক্ট করলেও গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের নয়, পুরো জাতির হৃদয় বিদীর্ণ করে দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে, সংবাদ সম্মেলনে ও সর্বত্র এই তরুণ পাইলটের আত্মত্যাগের প্রশংসায় মুখর হয়ে উঠেছে দেশবাসী। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানগণ তাঁর এই আত্মত্যাগকে “আদর্শিক ও বীরোচিত” বলে মন্তব্য করেছেন।
পাশাপাশি দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রাণহানি ও আহত হওয়ার ঘটনায় সারাদেশে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। স্কুল কলেজে কালো ব্যাজ ধারণ, মোমবাতি প্রজ্বলন এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ কর্মসূচি চলছে। শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তুলেছে—যুদ্ধবিমান কেন জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হবে? পুরনো চীনা FT-7 BGI সিরিজের যুদ্ধবিমানগুলো নিয়ে সেনাবাহিনী ও সরকার বারবার সতর্ক করা হলেও কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি—এই প্রশ্ন এখন জনমনে তীব্র হচ্ছে।
আইএসপিআর জানায়, এফটিইউ-৭ বিমানের ইঞ্জিনে হঠাৎ যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়, যার ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে বিমানটি। দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাইলটের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা ছিল বিমানটিকে জনবহুল এলাকা থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া, যাতে আরও বড় প্রাণহানির ঘটনা এড়ানো যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই প্রচেষ্টা আর সফল হয়নি।
পাইলট তৌকির ইসলামের এই আত্মদান শুধু একটি দুর্ঘটনার পরিসমাপ্তি নয়, বরং এটি একটি বড় প্রশ্নচিহ্নও রেখে গেছে সামরিক প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতির মান ও জননিরাপত্তা নিয়ে। সরকার বলেছে, বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ কৌশল এবং যন্ত্রপাতির মান যাচাই-বাছাই করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। নিহত ও আহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ঘোষণাও এসেছে সরকারের পক্ষ থেকে।
জাতি আজ এক পাইলট হারায়নি—হারিয়েছে এক নির্ভীক সৈনিক, এক সাহসী সিদ্ধান্তগ্রাহী তরুণ, যে নিজের জীবন দিয়ে শত জীবন বাঁচাতে চেয়েছিল।