থাইল্যান্ডে ফের রাজনীতিতে বড় ধাক্কা। মাত্র ১০ মাস আগে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে প্রধানমন্ত্রী হওয়া পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা বরখাস্ত হয়েছেন। কম্বোডিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের সঙ্গে তার একটি গোপন ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর পুরো দেশজুড়ে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা আর বিক্ষোভ। ফোনালাপে হুন সেনকে ‘চাচা’ বলে সম্বোধন করে সীমান্ত সংঘর্ষে থাই সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন পেতংতার্ন। সেখানে তিনি বলেন, “চাচা, আপনার যা দরকার, আমাকে বলবেন। আমি দেখব। বিরোধীদের কথা শুনবেন না।” থাইল্যান্ডের ৮১৭ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে বহুদিনের সামরিক-রাজনৈতিক উত্তেজনার সময় এই কথোপকথন প্রকাশ্যে আসতেই সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের অভিযোগ ওঠে।
ঘটনার পরদিনই দেশটির বিরোধীরা প্রতিবাদ শুরু করে এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি তোলে। বিষয়টি নিয়ে দেশটির ৩৬ জন সিনেটর সাংবিধানিক আদালতে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি পিটিশন দায়ের করেন। আদালত দ্রুততার সঙ্গে সেটি গ্রহণ করে এবং ১ জুলাই মঙ্গলবার ৭-২ ভোটে পেতংতার্নকে সাময়িকভাবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন থেকে বরখাস্তের নির্দেশ দেয়। মামলার রায় না হওয়া পর্যন্ত তাকে দায়িত্ব থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। তবে সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব আপাতত চালিয়ে যেতে পারবেন বলে জানানো হয়েছে। এই অবস্থায় দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী সুরিয়া জুংরুনগ্রুয়াংকিত ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জনের অভিযোগ ওঠার পর ক্ষমতাসীন সরকার জোটে ভাঙন ধরে। গুরুত্বপূর্ণ শরিক ভূমজাইথাই পার্টি জোট ত্যাগ করে। এতে পেতংতার্নের ফেউ থাই পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর মুখে পড়ে। তার জনপ্রিয়তাও তলানিতে গিয়ে ঠেকে। মার্চে যেখানে তার জনপ্রিয়তা ছিল ৩০.৯ শতাংশ, ফোনালাপ ফাঁসের পর তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ৯.২ শতাংশ। রাজপথে বিক্ষোভ দানা বাঁধে। সেনাবাহিনীও পরিস্থিতির ওপর কঠোর নজরদারি শুরু করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না গেলে থাইল্যান্ড ফের সেনা শাসনের মুখে পড়তে পারে।
এদিকে, ফোনালাপ ফাঁসের পর এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন পেতংতার্ন। তিনি দাবি করেন, এটি ছিল ব্যক্তিগত আলাপ এবং কূটনৈতিক কৌশলের অংশ। কোনো আনুগত্য বা জাতীয় স্বার্থ বিরোধী বক্তব্য দেননি। তবে আদালত তার সেই দাবি আমলে নেয়নি। তাকে ১৫ দিনের মধ্যে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে। জাতীয় দুর্নীতি দমন কমিশনও আলাদাভাবে এই ফোনালাপ নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
পেতংতার্ন বরখাস্ত হওয়ায় থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে সিনাওয়াত্রা পরিবারের ইতিহাসে আরেকটি নতুন ঘটনা যোগ হলো। এর আগে তার বাবা থাক্সিন ২০০৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে এবং ফুপু ইয়িংলাক ২০১৪ সালে ক্ষমতা হারান। এবার মেয়ে পেতংতার্ন ক্ষমতা হারাতে যাচ্ছেন। এই নিয়ে সিনাওয়াত্রা পরিবারের তৃতীয় সদস্য মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রিত্ব হারালেন। এ পরিবার গত দুই দশক ধরে থাই রাজনীতিতে দাপটের সঙ্গে রাজত্ব করে আসছিল। পেতংতার্নের নেতৃত্বাধীন সরকার মূলত দুর্বল অর্থনীতি চাঙা করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর এই ফোনালাপ কেলেঙ্কারিতে তা মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বর্তমানে থাইল্যান্ডের শেয়ারবাজার বড় ধসের মুখে পড়েছে। গত তিন দিনে থাই স্টক এক্সচেঞ্জ ৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমেছে। বিনিয়োগ কমেছে, পর্যটন খাত ক্ষতিগ্রস্ত। দেশের অর্থনীতি ও রাজনীতিতে অস্থিরতার ছায়া। কেউ কেউ বলছেন, ২০১৪ সালের মত সেনাবাহিনীর আবার ক্ষমতা নেওয়ার পথ তৈরি হতে পারে। কারণ অতীতেও যখন যখন সিনাওয়াত্রা পরিবারের জনপ্রিয়তা পড়ে গেছে বা বিতর্কে জড়িয়েছে, তখন সেনা হস্তক্ষেপ ঘটেছে। এবারও সেই ইঙ্গিত মিলছে থাইল্যান্ডের বিভিন্ন পর্যায় থেকে।
উল্লেখ্য, থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া ৮১৭ কিলোমিটার সীমান্ত বহুদিন ধরেই সামরিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ের সীমান্ত নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ এখনও চলছে। সেই উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্নের এমন ‘চাচা’ সম্বোধন করে ব্যক্তিগত আলাপ থাইল্যান্ডের জাতীয় নিরাপত্তা, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং সরকার পরিচালনায় বড় প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।