যাত্রাবাড়ী গণহত্যা নিয়ে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সম্প্রতি প্রকাশিত অনুসন্ধানী রিপোর্ট নিয়ে এবার মুখ খুললেন বাংলাদেশের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তিনি তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দীর্ঘ এক প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতিবেদনকে সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট, ভ্রান্ত তথ্যসমৃদ্ধ এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নওফেল জানান, বিবিসি নিজেদের নিরপেক্ষতার নীতিমালাকেই লঙ্ঘন করেছে।
নওফেল দাবি করেন, যে ১৮ সেকেন্ডের একটি সন্দেহজনক অডিও ক্লিপের উপর ভিত্তি করে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটির প্রকৃত রিসিভার কে, সেটি পর্যন্ত বিবিসি জানাতে পারেনি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, এই অডিও ক্লিপের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য যে সংস্থাকে প্রমাণসূত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, সেই সিআইডি দলীয়করণে পরিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত একটি প্রতিষ্ঠান।
এছাড়া যাদের ‘স্বাধীন অডিও বিশেষজ্ঞ’ বলে দাবি করা হচ্ছে, তারাও এই অডিওর ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে ‘নকল নয়’ এমন কিছু বলেননি। বরং বলেছে “highly unlikely to be fake”, অর্থাৎ ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা কম, কিন্তু একেবারেই অসম্ভব নয়।
নওফেল আরও অভিযোগ করেন, বিবিসি যে ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানকে ‘স্বাধীন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে তুলে ধরেছে, তিনিই ২০১১ এবং ২০২৩ সালে জামায়াতে ইসলামীর হয়ে কাজ করেছেন। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ও মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত সংগঠনের হয়ে কাজ করা একজন ব্যক্তির দেওয়া মতামত কতটা নিরপেক্ষ হতে পারে, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। তার মতে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিচ্ছেন এমন ব্যক্তি জামায়াতের হয়ে কাজ করেছেন — এটিকে নিছক কাকতালীয় ভাবা রাজনৈতিক সরলতা।
সাবেক এই মন্ত্রী অভিযোগ করেন, বিবিসি তাদের প্রতিবেদন তৈরির সময় শেখ হাসিনার ৭ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডের একটি বক্তৃতা থেকে মাত্র ৪০ সেকেন্ডের একটি অংশ কেটে নিয়েছে, যা তার মূল বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করেছে। তিনি বলেন, ওই বক্তব্যে শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে জীবনহানির ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং আন্দোলনে সহিংস অনুপ্রবেশকারীদের নিন্দা করেন। কিন্তু বিবিসি এই অংশগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে পরিস্থিতি বিকৃতভাবে উপস্থাপন করেছে।
নওফেল বলেন, এই প্রতিবেদনে কোনোভাবেই উল্লেখ করা হয়নি সেদিন পুলিশের ছয়জন সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনা, জেল ভেঙে ১০০ জনের বেশি জঙ্গির পালানো, হিযবুত তাহরীরের সদস্যদের স্বীকারোক্তি কিংবা দেশের ৪৫০টির বেশি থানায় চালানো হামলার তথ্য। বরং পুরো প্রতিবেদন সাজানো হয়েছে যেন সেটি একপেশে করে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের স্বার্থরক্ষায় কাজে আসে, শেখ হাসিনাকে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ফেলে এবং একটি প্রভাবিত বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী প্রমাণ করা যায়।
নওফেল বলেন, এই ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার শুধু আওয়ামী লীগ নয়, গোটা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য করা হয়েছে। তিনি আহ্বান জানান, জনগণকে সত্যের পক্ষে, পক্ষপাতমুক্ত তদন্তের দাবিতে এবং দেশবিরোধী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অবস্থান নিতে হবে।
তার বক্তব্যে স্পষ্ট করে জানানো হয়, বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থাকে যেন মিডিয়া ট্রায়ালের নামে তামাশায় পরিণত করা না হয়। তিনি বলেন, “আমরা সত্য জানতে চাই, বিচার হোক নিরপেক্ষভাবে। তবে দোষীদের সাজা নিশ্চিত হোক বাস্তব তথ্যের ভিত্তিতে, কোনো মিডিয়া প্রোপাগান্ডা বা আন্তর্জাতিক চাপের নয়।”
বিবিসির এই প্রতিবেদন নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘসময় অনুসন্ধান ও ফরেনসিক রিপোর্ট সামনে নিয়ে আসার পরও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবেদনটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে এবং এর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য খুঁজে বের করার দাবি উঠছে।
নওফেলের এই প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত দিল যে, যাত্রাবাড়ী গণহত্যা নিয়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে আরও উত্তাপ বাড়তে যাচ্ছে।