শুধু একটা মুঠো স্বপ্ন, আর তার পাশে ছিল নীরব এক প্রতিজ্ঞা—‘একদিন আমিও পারব।’ ঢাকার এক মধ্যবিত্ত ঘর থেকে উঠে আসা এক যুবক, যার পকেটে ছিল না পুঁজি, ছিল না বড় কোন পরিচয়, শুধু ছিল মেধা, অধ্যবসায় আর অনড় বিশ্বাস—তার জায়গা একদিন হবে বিশ্বমঞ্চে। আমরা যার কথা আজ বলছি তার নাম গাজী জিশান। পুরো নাম কামাল উদ্দীন গাজী জিশান। বাংলাদেশের কেন্দ্র ঢাকায় একজন তরুণ অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে আজ যিনি গড়ে তুলেছেন এক আন্তর্জাতিক মানের অ্যাকাউন্টিং আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান, তার এই রূপান্তর কেবল প্রেরণাদায়ী নয়, একেবারেই চলচ্চিত্রের মতো অবিশ্বাস্যও বটে। তার প্রতিষ্ঠিত ‘কর্মঠ’ এখন যুক্তরাজ্যের Huel, Pure, Little Moons, এবং Hotel Chocolat-এর মতো খ্যাতনামা ব্র্যান্ডের আর্থিক সেবায় নিয়োজিত — যা এক অর্থে বাংলাদেশের কর্মদক্ষতা ও পেশাদারিত্বের নিদর্শন বহন করছে।
গাজী জিশানের এই যাত্রার সূচনা হয়েছিল শৈশব থেকেই। তিনি স্কুলজীবনে অ্যাকাউন্টিংকে বেছে নেন নিজের উচ্চশিক্ষার বিষয় হিসেবে। তখন থেকেই তার চিন্তাভাবনায় একটি বিষয় স্পষ্ট ছিল — তিনি হতে চান এমন একজন পেশাদার, যার কাজ কেবল প্রতিষ্ঠানের হিসাব রাখা নয়, বরং সঠিক আর্থিক সিদ্ধান্তে সহায়তা করাও যার দায়িত্ব। গাজী জিশানের পরিবারের দিকে এবার ফেরা যাক। বাবা গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত ছিলেন, মা বুটিক ও হস্তশিল্প নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। পাশাপাশি মহিলাদের হস্ত ও বুটিক প্রসঙ্গে ট্রেনিংও করাতেন তার মা। পরিবারের এই পরিবেশে গাজীর ব্যবসা সম্পর্কে ভালো দখল শৈশব থেকেই বাড়তে থাকে। এ-লেভেল শেষ করে গাজী ACCA করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে।
তবে এই ভাবনা বাস্তবে রূপ নিতে তাকে পার করতে হয়েছে বহু চড়াই-উতরাই। যুক্তরাজ্যে এসে যখন একজন প্রশিক্ষণার্থী অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসেবে মাত্র ৮০ পাউন্ড বেতনে কাজ শুরু করেন, তখনই তার মধ্যে জন্ম নেয় নিজের ভিত শক্ত করার সংকল্প। ACCA শেষে দেশে ফেরার পর উচ্চ বেতনে চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি কারখানা বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রতিষ্ঠানে কাজ না করে বেছে নেন একটি প্র্যাকটিস ফার্মে কাজ করার পথ, কারণ তার মতে, একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে হলে তা শুরু হতে হবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে — যেখানে বিভিন্ন ক্লায়েন্ট, নানা হিসাবধারা এবং খুঁটিনাটি আইনের সংস্পর্শ পাওয়া যায়।
এই সংযম এবং দূরদর্শিতাই তাকে নিয়ে আসে পরবর্তী ধাপে, যেখানে তিনি নিজেই গড়ে তোলেন একটি ছোট পরিসরের অ্যাকাউন্টিং প্র্যাকটিস। তবে বাস্তবতা ছিল কঠিন। শুরুতে সবকিছু ঠিক থাকলেও, কোভিড-১৯ মহামারিতে সেই ব্যবসা ধাক্কা খায়, কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে। দিশেহারা না হয়ে বরং এটাই ছিল তার জন্য সুযোগ নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়ার। পুরো ব্যবসার মডেল বদলে ফেলেন তিনি। এবার তিনি নজর দেন আউটসোর্সিঙে, যেখানে বাংলাদেশের দক্ষ জনবল এবং যুক্তরাজ্যের ক্লায়েন্ট চাহিদার মাঝে সেতুবন্ধনের কাজ করতে শুরু করেন।
এই সিদ্ধান্তই পাল্টে দেয় তার জীবন। তিনি দ্রুত একটি গ্লোবাল অপারেশন গড়ে তোলেন, যেখানে আজ প্রায় ৫০ জনের বেশি কর্মী কাজ করছেন। প্রতি মাসে প্রতিষ্ঠানটির আয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৪,০০০ পাউন্ডে, এবং প্রতিবছর সেটি ছুঁয়ে ফেলেছে অর্ধ মিলিয়ন পাউন্ডের গণ্ডি। এই অসাধারণ অর্জনের পেছনে ছিল তার নিখুঁত ক্লায়েন্ট বাছাই, প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপদের সাথে কাজ করার কৌশল এবং ব্যক্তিগত পরিচিতি ও রেফারেলের মাধ্যমে ক্লায়েন্ট অর্জন করার দৃঢ়তা। অনেকেই যখন অ্যাডভার্টাইজমেন্ট আর ব্র্যান্ডিংয়ে ব্যস্ত, জিশান তখন মানুষের উপর ভরসা রেখেই প্রতিষ্ঠান বড় করেছেন। তার মতে, যদি কাজের মান ভালো হয় এবং ক্লায়েন্ট সন্তুষ্ট থাকেন, তাহলে তারাই হয়ে উঠবেন সবচেয়ে বড় মার্কেটার।
শুধু ব্যবসার মাঠেই নয়, জিশানের গল্পে রয়েছে ব্যক্তিগত সংগ্রামের নানা অধ্যায়। ACCA কোয়ালিফিকেশন ছিল তার জন্য এক সময় দুঃস্বপ্নের মতো। বারবার ব্যর্থ হওয়া, হতাশ হওয়া — এই সবকিছুই তাকে পেছনে টানেনি, বরং আরও এগিয়ে যাওয়ার জন্য মানসিক শক্তি দিয়েছে। তিনি বলেন, “যতবার ব্যর্থ হয়েছি, ততবার নিজেকে নতুন করে চেনার সুযোগ পেয়েছি। শিখেছি কীভাবে আরও ভালো হতে হয়, আরও প্রস্তুত হতে হয়।” এই মানসিকতা-ই হয়তো তার সবচেয়ে বড় সম্পদ — যে কারণে তিনি আজ এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছেন, যেখানে প্রতিটি সিদ্ধান্তে ফুটে ওঠে বাস্তবতা ও অভিজ্ঞতার ছাপ।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের জনপ্রিয় অ্যাকাউন্টিং কোচ রেজা হুদার পডকাস্টে অংশ নিয়ে তিনি তার এই অসাধারণ যাত্রার কাহিনী প্রকাশ করেন। রেজা নিজে বলেন, “গাজীর গল্প শুধু অনুপ্রেরণার নয়, এটা বাস্তবতা নির্ভর একটি রোডম্যাপ — যেটা অনুসরণ করলে যে কেউ নিজের প্র্যাকটিসকে গ্লোবাল স্তরে নিতে পারে।” এই পডকাস্টে গাজী তুলে ধরেন কিভাবে তিনি শুধুমাত্র দক্ষ কর্মী নিয়োগের ওপর জোর দেন, কীভাবে তিনি ক্লায়েন্টদের প্রয়োজন বুঝে তাদের জন্য নির্দিষ্ট টিম তৈরি করেন, এবং কিভাবে কর্মীদের মাঝে নেতৃত্ব গড়ে তোলেন যেন তারা নিজেরাই কোম্পানির ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে উঠতে পারে।
এইসব কাহিনীর মাঝে আরও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে — তার বাংলাদেশী পরিচয়। গাজী কখনও তা গোপন করেননি, বরং গর্বের সাথেই বলেন, “আমি বাংলাদেশের সন্তান, এখানকার প্রতিটি শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাকে আজকের জায়গায় পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।” তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে রয়েছে বিপুল সম্ভাবনাময় জনশক্তি, যাদের সঠিকভাবে ব্যবহারের সুযোগ থাকলে তারা বিশ্ববাজারে নিজের জায়গা করে নিতে পারে খুব সহজেই।
এই ফিচার শুধু একজন ব্যক্তির সাফল্যের গল্প নয়; এটি এক দেশের প্রতিচ্ছবি — যেখানে সীমিত সম্পদ, সীমিত সুযোগের মাঝেও একটি স্বপ্ন বাস্তব হয়ে উঠেছে ধৈর্য, পরিকল্পনা ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে। গাজী জিশানের পথচলা এখন শুধুমাত্র তার প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এক উজ্জ্বল উদাহরণ। একজন পেশাদার হিসেবরক্ষক হিসেবে শুরু করা এই যাত্রা এখন এক গ্লোবাল ফিন্যান্স লিডারশিপের দিকে এগিয়ে চলেছে — যা বলে দেয়, শুরুটা যত ছোটই হোক না কেন, মনের জোর থাকলে গন্তব্যটা হতে পারে সারা পৃথিবী।
গাজী জিশান আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন, বিদেশ মানেই কেবল শ্রমিক হয়ে টিকে থাকা নয়, বরং মেধা দিয়ে নেতৃত্বও দেওয়া সম্ভব — যদি মন থেকে চাওয়ার সাহস থাকে। বাংলাদেশ তার এই সন্তানের কৃতিত্বে গর্বিত। এবং সেই গর্বের গল্প আজ আমরা শুনছি নতুন করে, অন্যরকমভাবে — উৎসাহ, সাহস আর সীমাহীন সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে।