পুলিশের গাড়ি থেকে ফেলে দেওয়া সেই আসহাবুল ইয়ামিন এর মৃত্যু, যার দেহে তখনও ধুক ধুক করছিল প্রাণ, এদেশের প্রতিটি মানুষের মনে দাগ কেটেছে ভীষণভাবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (ওএইচসিএইচআর) এর রিপোর্টে সবিস্তারে উঠে এসেছে তার মৃত্যুর বিবরণ। এ যেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের মতো কাহিনী।
চলুন দেখা যাক, ওএইচসিএইচআর এর চোখে কেমন ছিল আসহাবুল ইয়ামিনের করুণ মৃত্যু।
“১৮ জুলাই, সাভারে পুলিশ শেখ আসহাবুল ইয়ামিন নামে এক নিরস্ত্র যুবকের ওপর বারবার গুলি চালায়। সে একটি নীল সাঁজোয়া যান (APC)-এর ওপর উঠে পুলিশের হাতে থাকা ধাতব শটগানের গুলিতে আহত হয়। এক প্রত্যক্ষদর্শী ইয়ামিনকে সেই সাঁজোয়া যানে ওঠার জন্য রাস্তা পার হতে দেখেছিলেন। সেই সময় তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান এবং পুলিশকে চিৎকার করে বলতে শুনেছিলেন যে ছেলেটির কাছে বোমা আছে। আরেক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য অনুযায়ী, ইয়ামিন APC-র ওপর উঠে যানটির ছাদের হ্যাচ বন্ধ করার চেষ্টা করে।
OHCHR এর রিপোর্টে ব্যবহৃত ছবি ও ক্যাপশন (অনুবাদ): “ছবি ৩৮ একটি যাচাইকৃত ভিডিও থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে পুলিশকে দেখা যাচ্ছে ইয়ামিনকে গুলি করতে।
ছবি কৃতজ্ঞতা: অনুমোদিত নথি।”
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় (OHCHR)-এর যাচাইকৃত ভিডিওতে দেখা যায়, ১৩:৫৭ মিনিটে APC সাভারের পুরাতন ওভারব্রিজের নিচে আসে। যানটি প্রায় ২০ মিনিট ধরে প্রধান সড়কে সামনে-পেছনে চলাচল করে এবং একাধিকবার টিয়ারগ্যাস ছোড়ে। ১৪:১৮ মিনিটে, ইয়ামিন সড়কের ব্যারিয়ার অতিক্রম করে APC-র পেছন দিক থেকে ছাদে ওঠে। তখন লাল শার্ট ও বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরা এক ব্যক্তি তাকে লক্ষ্য করে একবার শটগানের গুলি ছোড়ে। চার সেকেন্ড পর, দাঙ্গা-নিয়ন্ত্রণ পোশাক পরা এক পুলিশ সদস্য আরও তিনটি গুলি চালায়, যার ফলে ইয়ামিন APC-র ওপর পড়ে যায়। প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ গুলির সময় ধোঁয়ার অস্তিত্ব দেখা যায়।
OHCHR যাচাইকৃত অন্যান্য ভিডিও ও ছবিতে দেখা যায়, APC যানটি আহত ইয়ামিনকে ছাদে রেখেই ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যায়, তখনও সে বেঁচে ছিল। ভিডিও ফুটেজে একজনকে বলতে শোনা যায়, ‘এক্ষুণি মেরে ফেলো, পিস্তল দিয়ে গুলি করে তার মৃত্যু নিশ্চিত কর।’ তবে এরপর আর কোনো গুলি চালানোর ঘটনা দেখা যায়নি। তবে, আহত ইয়ামিনকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে পুলিশ সদস্যরা APC-র ছাদ থেকে ফেলে দেয়, ফলে তার মাথা ফুটপাতে আঘাত পায়।
এরপর, দাঙ্গা-নিয়ন্ত্রণ পোশাক পরা দুই পুলিশ সদস্য যানটি থেকে নেমে লাল শার্ট পরা ব্যক্তির সহায়তায় ইয়ামিনের দেহ রাস্তা পার করে পশ্চিম প্রান্তের দেয়ালের কাছে টেনে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর, APC দক্ষিণ দিকে চলে যায় এবং পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করে, রেখে যায় ইয়ামিনের দেহ। চলে যাওয়ার সময়, একজন পুলিশ সদস্য ইয়ামিনের দেহ লক্ষ্য করে একটি টিয়ারগ্যাস ক্যানিস্টার নিক্ষেপ করে, যার ফলে চারপাশ বিষাক্ত ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়।
ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের দিকে গুলি ছুড়ছে, যা এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্যমতে, প্রায় ১৫০ মিটার উত্তর থেকেও চলছিল। ওই সাক্ষী আরও জানান, পুলিশ বিভিন্ন দিক থেকে গুলি চালাতে থাকে। যখন ধোঁয়া ধীরে ধীরে কমে আসে, তখন ইয়ামিনকে শ্বাস নিতে দেখা যায়। কিন্তু OHCHR-এর হাতে থাকা কোনো ভিডিও বা প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণেই পুলিশ সদস্যদের আহত ইয়ামিনকে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার কোনো চেষ্টা সম্পর্কে উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
ভুক্তভোগী ইয়ামিনকে একদল প্রতিবাদকারী দুটি ভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যায়। সে দ্বিতীয় হাসপাতালে ১৪:৪৫ মিনিটে মারা যায়। OHCHR পরিচালিত ফরেনসিক মেডিকেল ও অস্ত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ইয়ামিনকে কাছ থেকে শটগানের ধাতব ছররা গুলিতে গুলিবিদ্ধ করা হয়েছিল। যখন তাকে হাসপাতালে আনা হয়, তখন সে ইতোমধ্যেই প্রচণ্ড রক্তক্ষরণ (হাইপোভোলেমিক শক) জনিত কারণে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল। OHCHR-এর ফরেনসিক ডাক্তার সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তার বুকের বাম দিকে দৃশ্যমান ছররা গুলির আঘাত, এবং একইসাথে নিঃশ্বাসের সাথে গৃহীত টিয়ার গ্যাসের ক্ষতিকর রাসায়নিক প্রভাব তার মৃত্যুর প্রধান কারণ বলে যৌক্তিকভাবে প্রতীয়মান হয়।
অন্যদিকে, পুলিশ বাহিনী মুহূর্তের উত্তেজনার কারণে হয়ত সাঁজোয়া যানে ওঠা ইয়ামিনকে সম্ভাব্য প্রাণঘাতী হুমকি হিসেবে দেখেছিল, কিন্তু সে যখন গুরুতর আহত ও অচল হয়ে পড়ে, তখন তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হয়। বরং, তাকে সাঁজোয়া যান থেকে ফেলে দেওয়া হয়, রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এরপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়, যা তাকে সম্পূর্ণভাবে আচ্ছাদিত করে ফেলে। এই ঘটনা ইয়ামিনের আঘাতকে আরও গুরুতর করে তোলে এবং অন্যান্য বিক্ষোভকারীদের তাকে দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়, ফলে তার হাসপাতালে স্থানান্তর বিলম্বিত হয়, এবং এভাবেই পুলিশ তার বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেয়।”
ইয়ামিনের নির্মম মৃত্যুর বর্ণনা জাতিসংঘের এই মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থাটি যেভাবে রিপোর্টে বিস্তারিত তুলে এনেছে, তা যেন অমোচনীয় কালিতে লেখা হাসিনার নৃশংসতার ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রইল।