নোটিশ:
শিরোনামঃ
সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথমবার চট্টগ্রাম যাচ্ছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস আমিরাতকে ১৪০ কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রির অনুমোদন যুক্তরাষ্ট্রের জামায়াতের নিবন্ধন ফিরে পেতে আপিলের শুনানি শুরু টেকনাফে আরাকান আর্মির হামলা: দুইজন গুলিবিদ্ধ, তিনজনকে ধরে নিয়ে গেল বিদ্রোহীরা যুদ্ধ বলিউড সিনেমা নয়, বাস্তবের বিভীষিকা— সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান অভিযোগ করতে গিয়ে হাজতে! গ্রেপ্তার আওয়ামী লীগ নেতা ঈদকে সামনে রেখে আগামী দুই শনিবার খোলা থাকবে শেয়ারবাজার বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির অভিযোগ: ১৭২ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্য চেয়েছে দুদক নিষিদ্ধ সংগঠন ঘোষণা আজ, আওয়ামী লীগের পক্ষে অনলাইনে সক্রিয় থাকলেই শাস্তি চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান: এক টেবিলে বন্ধুত্ব ও নিরাপত্তা

নীলচক্ষু মেয়ে

ডা. মুহাম্মদ মেহেদুজ্জামান
  • আপডেট সময় সোমবার, ২১ এপ্রিল, ২০২৫
  • ৫০ বার দেখা হয়েছে

জুলাইয়ের এক তারিখ; গত অক্টোবর থেকে প্রায় আট মাস ধরে নাফতালি এভাবেই আছে। এই সময়ের মধ্যে খুব সম্ভবত ওদেরকে ষোলোবার জায়গা বদল করতে হয়েছে প্রথম দিকে খুব খারাপ লাগতো, এখন আর তেমন একটা মন্দ লাগে না দিনকাল।সার্বক্ষণিক মৃত্যু ভয়ের যে আতংক ছিলো এখন নেই বললেই চলে।মানুষ আর কতবার মৃত্যুকে ভয়ে পেতে পারে।এক সময় মৃত্যুর সম্মুখ দর্শন জিনিসটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়।

নাফতালি জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়;দুপুরের তীব্র রোদ, বেশ গরম পড়েছে,মৃদু বাতাসে জলপাই গাছের ছোট ছোট পাতাগুলো দুলছে।অযত্নে পড়ে আছে সিলভার ওয়াটলের গাছটি,সবুজ পাতায় ধুলার আস্তরণ পড়ে গেছে।এটি ওর খুব প্রিয়।এককালে বাড়িতে পড়ার টেবিলের সামনে একটি ছিলো;প্রতি শীতের শেষে ফুল ধরত,সবুজ গাছটি একদম হলুদ,বাদামি হয়ে যেত।

দেয়ালের দিকে দু একটা পেঁপে গাছ,একটা পেয়ারা চারা;এরা সবাই নোংরা হয়ে যাওয়া বাড়িটার বাকি অতীত কালের গৌরব নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে।এর মালিক কোথায়,কে জানে হয়তো সপতিবারে মরে গেছে, আর নয়তো উত্তর থেকে রাফাহ ছুটে বেড়াচ্ছে।তাবুর সামনে আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছে। বিমান থেকে খাবারের প্যাকেট পড়বে, অথবা মিসাইল।ছুটতে ছুটতে কি এই ঠিকানার কথা মনে পড়ছে না আদৌ, এই সিলভার ওয়াটল, বেডরুমের দেয়ালে ঝুলানো তাজমহলের রেপ্লিকা,রান্নাঘর ভর্তি জলাপাইয়ের তেল! যেমন নাফতালির প্রায়ই মনে হয় নোরার কথা।

ওর সাথে শেষবার যখন আশদোদের সিমসন শেভা বীচে এক সন্ধ্যাবেলায় দু জন এক ক্যাফতে বসেছিলো।সন্ধ্যাবেলার ক্যাফেতে তখন অনেক মানুষ কিন্তু কী এক অদ্ভুত ধরনের নীরবতা।রাবার উডের বাদামি টেবিলের উপরে ডার্ক রোস্ট কফি কিছুটা লেবুর মত গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। বাদামি কাঠের উপর সাদা মগে কুচকুচে কালো কফি।টেবিলের দু পাশে ওরা দুইজন।ভূমধ্য সাগরের তীব্র বাতাসে নোরার সোনালি চুলগুলো উড়ছে।মাত্র মিলিটারি ট্রেনিং শেষ করে এসেছে। এ্যাসল্ট রাইফেল ধরে থাকা শূন্য হাতের অনামিকায় বাগদানের সাদা হীরের আংটিটা ক্যাফের নীল আলোয় নীলচে দেখাচ্ছে। সময় চলে যাচ্ছে সময়ের মত, আবার যেন যাচ্ছেও না।সমুদ্রের গর্জন,তীব্র বাতাস,উপরের আকাশে ঝিকিমিকি তারার আলো,যেন এক মধুর বিষন্নতম সময় এসেছিলো পৃথিবীতে।

নাফিতালির খুব কবিতা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছিলো, কিন্তু কবিতা ত সবাই লিখতে পারে না,লিখলেও সবারটা কবিতা হয় না।ওর বন্ধু খলিল পারতো,আরব খ্রিস্টান, চমৎকার প্রেমের কবিতা লিখতো,এই দেশের ভূমিপুত্র হিসেবে তার গর্ব,পূর্ব পুরুষের কথা,আর সেই সময়ের কথা লিখত,যখন পবিত্র ভূমিতে যুগ যুগ ধরে মসজিদে আযান হতো,চার্চে ঘন্টা বাজতো,সিনাগগে জেমিরথ গাইতো।চার বছর আগে খলিল মারা যায়। আরব ইসরাইল দাঙ্গায় পুলিশ সরাসরি ওর বুকে গুলি করেছিলো।গুলি করার আগে একবারও দেখতে পায় নি ওর বুকভরা ভালোবাসা,মাথাভর্তি কবিতা আর চোখ ভর্তি স্বপ্ন,কুদসের মাটিকে স্বাধীন করার স্বপ্ন।নাহ ওর হত্যার কোনো বিচার হয় নি।সভ্যতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভয়ংকর বর্ণবাদী এই সমাজেয় আরবদের জীবনের মূল্য কুকুরের চেয়েও কম।

নাফতালির জীবনের ট্রেনিং এর দিনগুলোর স্মৃতিই সবচেয়ে ভয়ংকর। ওদের অনক টিম থাকতো ছোট ছোট,আট জন দশ জনের টিম।চারমাসের ট্রেনিং এ মাঝে মাঝে ওদের রেইডে যেতে হত।এখানে কোনো অফিসিয়াল প্রটোকল, সামরিক নিয়ম কিচ্ছু মানা হতো না।এগুলো থাকতো গোপনীয় ;মিডিয়ায় আসতো না।ইসরাইলিরা অনেকেই সবাই এটা জানতো।তবে স্যাডিস্ট সমাজের উৎপাদিত সন্তানদের কাছে রেইডের দিনগুলো ছিলো সবচেয়ে আকর্ষণের, এরা বড়দের কাছে এ সম্পর্কে শুনতো,যতবার ওর কোনো সমবয়সীকে মিলিটারি ট্রেনিং নিয়ে আলাপ করতে দেখেছে,সবাই রেইড নিয়ে কথা বলত,সামরিক ট্রেনিং, সামরিক জীবন এসব কিচ্ছু থাকতো না ওদের আলাপে।

হঠাৎ গভীর রাতে আরব বসতিগুলোতে চলে যেত,একেক সময় একেক বাড়িতে ঢুকে যেত। হইহুল্লোড় করা,কুকুর দিয়ে বাচ্চা বয়স্কদের ভয় দেখানো,সিগ্রেট ধরানো,তরুণ বয়সী কেউ থাকলে দু চারটে লাথি,লাঠি দিয়ে পিঠে পশ্চাতে আঘাত,কোরআন সামনে থাকলে পাতা ছেড়া,প্রফেট মুহাম্মদকে নিয়ে কটূ কথা বলা এসবই হতো।কোনো পেশাদারিত্ব ছিলো না।দুনিয়ার আটদশটা সভ্য দেশের আর্মি প্রশিক্ষণের সাথে এর মিল নেই।এখানে কোনো পেশাদারিত্ব নেই,কিছু দুর্বল নিরস্ত্র মানুষের উপর অত্যাচার ছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য নেই।

কিন্তু সবসময় রেইড আসলে এতটুকুও ভালো থাকতো না।যেমন একদিন শীতের রাত হবে,রামাল্লার পশ্চিম দিকের এক বসতিতে যায় ওরা। দশ জনের দল,টিম লিডার একজন মাস্টার সার্জেন্ট, বেন ইজার।বেন ইজার বাড়িতে ঢুকেই বাড়ির বৃদ্ধ মালিককে বুট দিয়ে জোরে জোরে লাথি মারতে থাকে।ভেতর থেকে বাচ্চাদের চেচামেচির আওয়াজ আসে।সার্জেন্টের মাথায় যেন খুন চেপেছে আরো লাথি দিতে থাকে।লোকটি ব্যাথায় কাতরায়।হঠাৎ ভেতর থেকে ছোট্ট একটা মেয়ে বেড়িয়ে আসে,এখনো টিন এইজে পড়ে নি।এগারো বারো বছর বয়স হবে,চোখ দুটো নীল।সার্জেন্টের হাত থেকে বাবাকে ছাড়ানোর প্রাণপন চেষ্টা করছে।নিজের শরীরেও লাথির আঘাত পড়ছে।এক সময় বেন ইজার সরে আসে।তারপর ঠান্ডা মাথায় যে কাজটি করে, তা আগে নাফতালি যদি মরে যেত তাহলে হয়তো বেঁচে যেত।

ছ’বছরের একটা বাচ্চার বুক বরাবর তার সাইল্যান্সার লাগানো এম ১৪ সেমি অটোম্যাটিক রাইফেলের নল ধরে, সবাইকে বলে দেয় যা সে আদেশ করবে তাই হবে,কেউ বাঁধা দিলে বুলেট বাচ্চার বুকে চলে যাবে।টিমের সবাইকে আদেশ করে বাচ্চা মেয়েটির গণ সম্ভ্রবহানির,হে ঠিক এরকমই অর্ডার ছিলো তার।মধ্যবয়সী লোকটি তার স্ত্রী সার্জেন্টের পায়ে লুটিয়ে পড়ে, কিন্তু না সেদিন কিছুতেই কিছু হয় নি। দলের প্রতিটি তরুনও যেন ছিলো অতি উৎসাহী।বিশেষ করে সবচেয়ে শান্ত বলে যাকে গত তিন চার মাস ধরে জানতো ,সেই এরিয়েল -তার উদ্দীপনা সবার চেয়ে বেশি।নাফতালি ছোটবেলায় শয়তানের গল্প শুনতো,সেদিন সাক্ষাৎ অনেক গুলো শয়তান দেখেছিলো।ওর এতটুকু সৌভায় ছিলো,ওখান থেকে একাই পালিয়ে এসেছিলো।এ নিয়ে আর ঝামেলাএ হয় নি।ট্রেনিং শেষ হওয়ার ছ’মাসের মধ্যেই ও জানতে পারে বেন ইজার আত্মহত্যা করেছে।ওই দিন পুরোটা সময় ওর খুব ভালো লেগেছিলো।আর বারবার এই নীলচক্ষু মেয়েটির কথা মনে হয়েছিলো।

এরপরেই ওর সাথে নোরার বাগদান, বিয়ে। হঠাৎ হামলা,আর এই বন্দী জীবন।আরবদের সে কোনোদিনই ঘৃণা করে নি।এক আরব দম্পতি তার দাদার জীবন বাঁচিয়েছিলো একবার,সেই থেকে ওর পরিবারে আরবদের খুব সম্মান করা হত।৬ তারিখ সন্ধ্যাবেলাটা নোরার সাথে আশদোদ বীচে কাটিয়ে ও গিয়েছিলো আশদোদ এয়ার বেইজে ওর মেজর বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করতে।রাতটা কী ভেবে থেকেই গিয়েছিলো,ভোরবেলাতেই হামলা।

তারপর গত আটমাসে কত জায়গায় গেলো,কত বোমা, কত মৃত্যু দেখলো। সাজানো গোছানো একটি জনপদ কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হলো।

নাফিতালি খুব ভালো করেই জানে বিবির আর্মি ওকে দেখলে গুলি করে মেরে ফেলবে,উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম।জীবিত জিম্মি বিবির রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য ঝামেলা, যুদ্ধের নীতির জন্য কিছুটা বাঁধা।যতদিন এরা বেঁচে আছে ভিতরে বাইরে নানা চাপ।সবাই মরে গেলে সে বরং দায়মুক্ত হবে, সব দোষ হবে কাসাম,পিআইজে ব্রিগেডের।

অ্যাপাচে কপ্টার তীব্র ঘটঘটানিতে নাফিতালির ধ্যান ভেঙ্গে যায়।বিকেল হয়ে গেছে,পাহারায় থাকা ছেলেগুলো ব্যাস্ত,চোখে মুখে আতঙ্ক নেই তবে ব্যাস্ততা আছে,উদ্বেগ আছে কিছুটা।সম্ভবত মার্কিন ডেল্টা ফোর্স। সারা দুনিয়ায় জিম্মি উদ্ধারের জন্য এরা বিখ্যাত।কপ্টারের শব্দ আরো তীব্র হচ্ছে, নীল চোখের ছোট্ট মেয়েটির কথা মনে হচ্ছে।মেয়েটির চোখে ঘৃণা।নাফতালি আতিপাতি করে কি যেন খুঁজছে, সম্ভবত কোনো এ্যসল্ট রাইফেল।

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT