গৃহকর্মী ও যৌনকর্মী উভয় শ্রেণীকেই ‘শ্রমিক’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। শনিবার (১৯ এপ্রিল) বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই সুপারিশ প্রতিবেদন হস্তান্তর করে কমিশন। এসময় কমিশনের সদস্যরা প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রধান উপদেষ্টার সামনে তুলে ধরেন। সুপারিশগুলোর মধ্যে আছে– শ্রম আইনে গৃহকর্মী ও যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব বলে মনে করে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
এদিকে সংবাদটি প্রচার হওয়ার পর থেকেই সারাদেশে উঠেছে সমালোচনার ঝড়। ধর্মীয় ভাবাপন্নপ্রধান মানুষের দেশে এমন সুপারিশকে নেতিবাচক চোখেই দেখছেন সচেতনমহল ও সাধারণ মানুষরা। এই সুপারিশের মাধ্যমে প্রকারান্তরে যেন গৃহকর্মী ও যৌনকর্মীকে এক কাতারে নামিয়ে আনা হলো-এমনটাও ভাবছেন অনেকে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যৌনকর্ম বাংলাদেশে কোনো সম্মানজনক পেশা নয়, এবং সাধারণত কোনো নারী স্বেচ্ছায় এই পেশায় যেতেও চান না। যারা এই পেশায় আছেন তারাও পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ পেলে ছেড়ে দেবেন। কিন্তু রাষ্ট্র তাদেরকে পুনর্বাসনের সুযোগ করে না দিয়ে স্বীকৃতি দিয়ে যেন এই পেশাতে চিরস্থায়ীভাবে রেখে দেয় সেই ব্যবস্থা করারই যেন “আবদার” জানিয়েছে সংস্কার কমিশন। একদল নারীকে নিয়ে গঠিত একটি কমিশন যে নারীর মর্যাদা ভূলুণ্ঠনকারী এমন প্রস্তাব দেবে তা অকল্পনীয় ছিল- এই কথাও বলছেন অনেকে।
এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক অধ্যাপক বলেন, “যৌনকর্মীদের জীবন সুরক্ষিত করা জরুরি। কিন্তু সেটি ‘শ্রমিক’ নামের এক ট্যাগ দিয়ে পেশাটিকে স্বাভাবিক ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত করে তোলার মধ্য দিয়ে নয়। বরং রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের এমন পথ দেখানো যাতে তারা এ জীবন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।”
নারী কমিশনের এমন সুপারিশ দেখে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন—এটি কি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পতিতাবৃত্তির সুযোগ করে দেওয়ার সুপারিশ নয়? “শ্রমিক” তকমা লাগিয়ে যৌনকর্মীদের আইনি ছাতা দেওয়ার পেছনে যেন এক প্রকার কৌশল রয়েছে—রাষ্ট্র দায়মুক্তি চায়, কিন্তু দায় নিতে চায় না। যৌনশোষণ রোধে কোনো সুপারিশ নেই, নেই মানবিক পুনর্বাসনের প্রস্তাব। আছে শুধু ‘শ্রমিক’ নামক একটি নতুন তকমা—যা তাদের লাঞ্ছিত পেশাকে বৈধতা দিলেও মুক্তি দেয় না।
এই বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক বিশিষ্ট মনোবিদ বলেন, সুপারিশ বাস্তবায়িত হলে সমাজ বুঝবে যে পতিতাবৃত্তিও রাষ্ট্রস্বীকৃত একটি পেশা। এতে অনেক তরুণী শ্রমসাধ্য ক্যারিয়ার খোঁজার পরিবর্তে সহজসাধ্য এই পেশায় আসতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, যা আমাদের দেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। অথচ চাইলেই যৌনকর্মীদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ, নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন প্রোগ্রাম, সন্তানদের জন্য শিক্ষা সহায়তা এসব বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা যেত।
প্রতিবেদন বিষয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভিন হক বলেন, আমরা জানি অনেক কিছু নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হবে, আমরা সেই বিতর্ককে স্বাগত জানাই। কারণ আমরা মনে করি, এখন ২০২৫ সাল, হাইটাইম—এগুলো নিয়ে জনপরিসরে আলোচনা হোক, বিতর্ক হোক, জানাজানি হোক, মানুষ জানুক নারী কী চায়, নারীর স্বপ্নটা কী।
ইতোমধ্যেই শিরীন হকের এই বক্তব্য নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে। অনেকে বলছেন, এদেশের একজন সাধারণ নারীর স্বপ্ন আর যাই হোক পতিতাবৃত্তি পেশাকে বেছে নেওয়া নয়।