
সাহিত্যপাড়ায় ‘ওবায়েদ হক’ নামটা কেমন সাড়া জাগানিয়া সে বোধ করি যারা বাংলা বইটই পড়েন, হালের বাংলা সাহিত্যের খোঁজ রাখেন- তাদের কাছে মোটেই অজানা নয়।
আমি যখন তাঁর ‘নীল পাহাড়’, ‘জলেশ্বরী’, ‘তেইল্যা চোরা’ এবং একমাত্র গল্পগ্রন্থটি পড়েছিলাম, তখন মনে হয়েছিল তিনি হয়তো সত্যিকারভাবে এখনকার সময়ের খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে উঠবেন। যদিও তিনটা উপন্যাস আর কয়টা গল্পের লেখককে প্রতিষ্ঠিত ভাবাটা অনেকের কাছে ধৃষ্টতা মনে হতে পারে, কিন্তু তিনটা উপন্যাসে তিনি যে সম্ভাবনার সুর তুলেছিলেন তাতে ঐ সময়ে তেমন ভাবাটাও দোষের ছিল না খুব একটা।
ওবায়েদ হকের বইগুলো শুরুর দিকে এলোমেলোভাবে বিভিন্ন প্রকাশনীতে প্রকাশিত হতে থাকে। এক জলেশ্বরীই সম্ভবত তিন কি চারটা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর ’২০ সালে বইগুলো (উপন্যাস) তৎকালীন নতুন একটি প্রকাশনী বায়ান্ন হতে পুনরায় প্রকাশিত হয়। এরপর লম্বা সময় তার কোনো লেখা পাওয়া যায়নি। পাঠক হিসেবে আমরা যারা বিভিন্ন অপরিণত, না-সাহিত্য লেখার লেখককে খালি মাঠে সেলিব্রিটি লেখক হয়ে যেতে দেখতাম, তখন মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করতাম যে, আমাদের ওবায়েদ হককে কবে এমনভাবে বড়ো মঞ্চে দেখব! আফসোসও হতো- আদৌ কি দেখব?
আবার এও ভাবতাম যে, ওবায়েদ হক নিভৃতচারী মানুষ। ভিড়ভাট্টা, আলোর ঝলকানিতে তার অস্বস্তি। লিখুক উনি ওনার মতো। মনে আছে, ঐ সময়ে বহু মানুষকে আমি তার বই পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম (এখনও করি)।
দীর্ঘ বিরতির পর সম্ভবত ’২১/’২২ সালে বায়ান্ন থেকেই আসলো তার উপন্যাস ‘কাঙালসংঘ’। প্রবল আগ্রহ নিয়ে কিনতে গেলাম। অভ্যেসবশত কেনার আগে ভেতরে পড়তে গিয়ে যেন বিরাশি সিক্কার নকআউট পাঞ্চ খেলাম। বানানভুলের এমন সমারোহ শেষ কবে দেখেছিলাম জানি না। এখানে একটু বলে রাখি, ওবায়েদ হক হলেন এমন একজন লেখক যার কাজ শুধু লেখা। লিখেন, কাটেন, আবার লিখেন, আবার কাটেন। যার জন্মই হয়েছে যেন লিখে যাওয়ার আকণ্ঠ তৃষ্ণা নিয়ে। তো এমন মানুষরা লেখার অন্যান্য অনুষঙ্গ- বানান, বইয়ের সেটাপ ইত্যাদি বিষয়ে কিছুটা বা পুরোটা অজ্ঞ কিংবা উদাসীন থাকবেন এটাইতো হবে, নয় কি? এসব ব্যাপারগুলো সাধারণত প্রকাশক পেশাদার কাউকে দিয়ে ঠিক করিয়ে নেন।
কিন্তু ‘কাঙালসংঘ’ যেন কোনো ধরনের ঘষামাজা ছাড়া স্রেফ লেখকের লেখাটাকেই বইয়ে রূপ দিয়ে বাজারে নিয়ে আসা হলো। তখন আমার মতো আরো অনেক ওবায়েদ প্রেমীই বইয়ে থাকা বিভিন্ন ভুল নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে পছন্দের লেখকের বই কিনতে না পারায় কষ্ট পেয়েছিলাম অনেক। সাথে অনেকের মুখ থেকে এও জানা গেল যে, দীর্ঘ অপেক্ষার পর যেমন আশা করা হয়েছিল, ওবায়েদ তা পূরণে অনেকাংশে ব্যর্থ। তবে যেহেতু বইটা আর পড়িনি, তাই সে বিষয়ে মন্তব্য অনুচিত।
এরপর আবার বিরতি দিয়ে গত বছর তার দুটো বইয়ের সংবাদ পাই। ‘আড়কাঠি’ এবং ‘জল নেই, পাথর’। দ্বিতীয়টি কোনো বাছবিচার ছাড়াই কিনি। তবে প্রথম বইটির বিষয়বস্তু আগ্রহ জাগানিয়া হলেও সেই পুরনো রোগ বানান ভুলের ছড়াছড়ি আর দুর্বল পেইজ সেটাপ দেখে কিনিনি আর। ‘জল নেই, পাথর’ লেখকের কলমের শক্তির জোরে টেনেটুনে শেষ করা গেলেও শুরুর দিকের বইগুলোর তুলনায় বিলো এভারেজের কাতারে পড়ে রইল। কোথায় যেন শক্তিশালী লেখনীর ওবায়েদকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না।
সবশেষে এবার ’২৫ এর বইমেলাতে এলো তার উপন্যাস ‘উন্মাদ আশ্রম’। জি, বানানভুলের সাথে এবার যুক্ত হয়েছে বইয়ের পৃষ্ঠাবিন্যাস ও অলংকরণের ভয়াবহ বিপর্যয়! ইচ্ছাকৃত বইয়ের কলেবর বৃদ্ধিতে অসংলগ্ন স্পেস, পৃষ্ঠা ফাঁকা রাখা, ফন্ট সাইজের অসামঞ্জস্য, লাইন সরে যাওয়াসহ হেন বিপর্যয় নাই যা এই বইয়ে হয়নি। লেখার মান অনেক নিচে। আর প্রচ্ছদ? নীলক্ষেতের এইট পাস ডিজাইনারও হয়তো আরো যত্ন নিয়ে প্রচ্ছদ করতো। প্রকাশনী থেকে অবশ্য বুক ফুলিয়ে বলছে- ‘কলিকাতার আটিস’ দিয়া কভার করাইছি।
প্রকাশক কে? জি, ঠিক ধরেছেন। বায়ান্ন!
সাহিত্য কিংবা বইয়ের টেকনিক্যাল দিক সম্পর্কে বায়ান্ন কতটুকু জ্ঞান রাখে তা ‘উন্মাদ আশ্রম’ এর কয়েকটা পাতা উলটালেই ধরা যায়। তাদের আরো দুই একটা বইয়েও এমন দুর্বল ম্যানেজমেন্ট দেখা গেছে। ওবায়েদের বই মেলাতে ছাপানো গেছে- এই খুশিতেই তারা তখন বাকবাকুম।
যাইহোক, এ পর্যায়ে এসে আমার কাছে মনে হয়েছে, ওবায়েদ হক সম্ভবত আমাদের সময়ের দুর্ভাগা লেখকদের একজন। আমরা জানতাম যে, প্রকাশক লেখকদের খুঁজে বের করে তাদেরকে আরো বেশি লেখক হতে সাহায্য করেন। অথচ বারবার ওবায়েদ হক পড়লেন প্রকাশক নামধারী কিছু ‘ফড়িয়া’দের হাতে। দুঃখিত, হয়তো একটু বেশিই রূঢ় শব্দের ব্যবহার কাউকে অনেক অপমানিত করতে পারে, কিন্তু পছন্দের লেখকের ক্রমশ নিম্নগামী যাত্রায় আপনাদের লোভী অবদানকে আর কীভাবে বিশেষায়িত করা যায়!
একটা বই প্রকাশের আগে প্রকাশক সেই বইটা পড়েন, লেখককে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। অথচ ওবায়েদের শেষের দিকের বইগুলো পড়লে বোঝা যায় তিনি বানরের গলায় মুক্তার মালা হয়ে ঝুলেই ক্ষান্ত দেননি, বানরের বাঁদরামিতে (পড়ুন তার বই নিয়ে পাঠকদের সাথে প্রকাশকদের প্রতারণামূলক আচরণে) মুক্তার ঔজ্জ্বল্যও ম্লান করে ফেলেছেন।
আমি শুধু ভাবি, এমন অনেক প্রকাশনী আছে, যারা ওবায়েদ হকের বই করতে পারলে তাকে তাজ বানায়ে রাখবে। বইয়ের প্রতিটা যত্নে সবটুকু ঢেলে দেবে। অথচ, যারা বিনা পরিশ্রমে ওবায়েদকে পেয়ে গেল, তারা এতটুকু মর্ম বুঝল না তার!
কবি ইমতিয়াজ মাহমুদের (ভুল হলে শুধরে দিয়েন) একটা ম্যাক্সিম এমন ছিল সম্ভবত (আমার পুরো মনে নাই, তবে ভাব অনেকটা এমনই) যে, পাগলকে সুস্থ করলে মূলত তুমি তাকে স্বর্গ থেকে নরকেই ঠেলে দিলে।
তো, ওবায়েদ হককে আমার তেমনই লাগে। নীভৃতে থাকা একজন লেখক, লেখা ভিন্ন আর কিছুই যিনি জানতেন না, জাগতিক খ্যাতি, আলোর ঝলকানি, ইন্টারভিউ, লোকের ভিড় ইত্যাদি বিষয়ে যার প্রবল অনাগ্রহ; সেই মানুষটাকে আমরা আলোয় এনে সবার সামনে উন্মুক্ত করে দিলাম। তাকে বুঝালাম লেখক হতে হলে এসব সাক্ষাৎকার, অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফ, ইভেন্ট, হপ্তায় হপ্তায় মেলায় হাজিরা দেওয়া ইত্যাদি লাগে। যেই মানুষটা জাগতিক, বাণিজ্যিক মেকি চাহিদা থেকে শতহাত দূরে থেকে নিজেকে প্রতিনিয়তই ছাড়িয়ে যাওয়ার কাজে লিপ্ত ছিলেন, সেই তিনিই যেন উল্লিখিত চাহিদার চোরাস্রোতে ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার অদৃশ্য টানে আটকা পড়েছেন।
লোকমুখে শোনা যায়, লেখক লিখেছেন প্রকাশকের চাপে পড়ে। কারণ বায়ান্নর মতো প্রকাশকদের কাছে ওবায়েদ হকেরা হলেন সোনার ডিমপাড়া হাঁসের মতো। যারা কোনো পরিশ্রম, তদবির ছাড়াই ওবায়েদের মতো লেখকদের পেয়ে যান। যেহেতু বাজারে বলার মতো পরিচয় নিয়ে টিকে থাকার যোগ্যতা সেসব প্রকাশকদের নাই, তাই তারা ওবায়েদদের মতো লেখকদের সবটা নিংড়ে ছোবড়া বানিয়ে ছাড়েন। কারণ এসব ফড়িয়া প্রকাশকেরা ওবায়েদদেরকে নিজেদের সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে নতুন নতুন মুরগি লেখক (প্রকাশকদের ভাষায়) ধরার ধান্দায় থাকেন।
তা ভাই, মুরগি ধরেন আর বাঘ-ভাল্লুক ধরেন ডিমপাড়া হাঁসটার যত্ন তো করবেন! না-কি ভাবেন, বছর বছর খুদকুঁড়ার মতো কিছু টাকা রয়্যালটি ছিটাইলেই যেখানে হয়ে যাচ্ছে, সেখানে এত যত্নের কী দরকার? শুধু খুদ ছিটায়া চাপ দিয়া নতুন বছরের খোরাকটা পাইলেই তো কাম সারা। যেখানে প্রকাশককে প্রুফরিডিং এর জন্য খরচ করতে হয় না, নাই সম্পাদনায় খরচের প্যারা, মেকাপ-সেটাপ খয়রাতি মার্কা হলেও চলে, নাই মার্কেটিং এর চাপ, লামসাম প্রচ্ছদেই কাজ হয়ে যায়; সেখানে দরকার কী এসবে খরচ করার।
যে কারণে ওবায়েদ হকের মতো লেখকের হাত থেকে বের হয় ‘কাঙালসংঘ’ কিংবা ‘উন্মাদ আশ্রম’ এর মতো হতাশাজনক লেখা। লেখকের নামের ভারে হয়তো বেশ কয়েক এডিশন বই বেচে প্রকাশক ব্যালেন্স ভারী করবেন, কেউ ভুলের ব্যাপারে জানতে চাইলে ভুংভাং ৪২০ বুঝাবেন, কিন্তু পাঠক বোকা না, ভোদাই না। তারা আপনাদেরকে লাল দাগ দিচ্ছে।
আর ওবায়েদ হক কি বুঝতে পারতেছেন যে, পাঠক তার উপর দিন দিন আস্থা হারাচ্ছে? যেখানে তার পাঠকেরা অপেক্ষমান যে তাদের প্রিয় লেখক সামনে মাস্টারপিস কিছু লিখতে যাচ্ছেন যা তাকে কালজয়ী করে রাখবে, অথচ এখন তিনি হারিয়ে যান কি-না ভেবে শঙ্কিত। পাঠকের কাছে হয়তো এখনো ‘প্রিয় লেখক’ হয়ে আছেন, তবে প্রকাশকের কাছে সম্ভবত ইত:মধ্যে আজ্ঞাবহ কিছু একটা হয়ে গেছেন। যাকে চাপ দিলেই বই নামে কিছু একটা বানিয়ে টাকা ক্যাশ করা যায়। না মানে, চারপাশে এমনই গুঞ্জন ভাসছে কিছুটা।
আমি লেখকের একটি ছোটোগল্প ‘প্রায়শ্চিত্ত’ অবলম্বনে নির্মিত একটি ভিজ্যুয়ালে অভিনয় করেছিলাম। সামনাসামনি সাক্ষাতে ব্যাপারটা বলায় খুশি হয়েছিলেন। সাথে এও জানালেন, ভিজ্যুয়াল কাজটা তিনি দেখেননি। কারণ ওনার শঙ্কা, যদি ওনার চিন্তার সাথে পরিচালকের চিন্তা না মিলতে দেখেন, তবে স্বীয় গল্পের অপমৃত্যু হয়েছে ভেবে কষ্ট পাবেন। নিজের লেখার প্রতি এতটা ভালোবাসা যার, তাকে বাণিজ্যের ফাঁদে ক্রমশ হারিয়ে যেতে দেখা খুবই দুঃখজনক। একই সাথে লজ্জারও। সেই লজ্জা প্রকাশকদের, যারা কটা কাঁচা টাকার লোভে বাংলা সাহিত্যে আরেকজন হক সাহেবকে আসতে দিতে চাচ্ছেন না। উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রকে পতিত করছেন জোর করে। আপনাদের মতো প্রকাশকদের শতকোটি ধিক! একজন লেখক হারালে হয়তো ব্যাবসা করার জন্য আপনি আরো দশজন লেখক পাবেন, কিন্তু আমরা জানি একজন ওবায়েদ হক হারালে আরেকজন ওবায়েদকে আগামী কয়েক প্রজন্ম নাও পেতে পারে।
আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, লেখকের উচিত বিরতি নেওয়া। যেহেতু আপনি রংচং, হইচই, সেলিব্রিটি ম্যাটেরিয়াল না- সুতরাং, আপনি নিভৃতেই থাকুন। নিজের খেয়ালে লিখুন। প্রয়োজনে আর কিছু যদি নাও লেখেন- আমরা আপনার পাঠকেরা ‘সমাজের চাপে হারিয়ে ফেলা প্রেম’ এর মতো আপনাকে স্মরণে রাখব। অপেক্ষায় থাকব আপনি সত্যিই মাস্টারপিস কিছু আনবেন, কালজয়ী হবেন। নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করবেন বাংলা সাহিত্যাকাশে। কিন্তু নেক সুরতে ফড়িয়া গোছের কেউ আপনাকে সবার সামনে ‘আজ্ঞাবহ দাস’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে- এরচেয়ে লজ্জার কিছু আমাদের জন্য হবে না হয়তো। প্লিজ!
- দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর সর্বশেষ নিউজ পড়তে ক্লিক করুন: সর্বশেষ
- দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর ফেসবুক পেজটি ফলো করুন: dailysabasbd