সারা দেশে টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ফলে ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদনদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে, ভেঙে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, প্লাবিত হয়েছে শত শত গ্রাম ও নগর এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, পানিবন্দি হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ।
ফসলি জমি, মাছের ঘের ও বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে।
ফেনী জেলায় ভারী বর্ষণ ও উজানের ঢলে মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ১৪টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ৩০টির বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে মুহুরী নদীর পানির উচ্চতা ছিল ১৩.৯২ মিটার, যা বিপৎসীমার চেয়ে প্রায় দেড় মিটার বেশি। বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে বহু এলাকায়, তলিয়ে গেছে বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ও মিটার। ইউএনও ফাহরিয়া ইসলাম জানান, তিনটি নদীর চারটি স্থানে বাঁধ ভেঙেছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রে শতাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।
কক্সবাজারে ২৪ ঘণ্টায় ৭৮৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। সেন্ট মার্টিন, টেকনাফ, উখিয়া ও শহরের অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি ঢলে বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাহাড় ধস ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কর্তৃপক্ষ পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
সাতক্ষীরায় এক সপ্তাহের টানা বর্ষণে বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা দুর্বল থাকায় পানি নামছে না, ফলে শহরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা ও সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আমন বীজতলা, আউশ ধান ও সবজি খেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, ভেসে গেছে মৎস্য ঘের।
খুলনায় টানা বৃষ্টিতে শহর ও গ্রামীণ এলাকার বহু রাস্তা, ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পাইকগাছা, ডুমুরিয়া ও তেরখাদা উপজেলায় সবজি ও ধানের খেত, মাছের ঘের ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
রাজশাহীতে এক সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। পদ্মা নদীর পানি প্রতিদিন বাড়ছে, যা স্থানীয়দের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। চরখিদিরপুরসহ নদীপাড়ের কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, ফারাক্কা ব্যারাজের গেট খোলার ফলে এই পানি বৃদ্ধি ঘটছে।
খাগড়াছড়িতে চেঙ্গি ও মাইনি নদীর পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। বাজার ও গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো প্লাবিত। বান্দরবানে টানা বৃষ্টিতে জনজীবনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। পাহাড়ি এলাকার মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না।
মোংলা শহরের ৯টি ওয়ার্ডে পানি ঢুকে পড়েছে ঘরে ঘরে। রান্নাঘর, পুকুর, রাস্তা সব পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকে খাট বা টোঙ্গার উপর আশ্রয় নিয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বৃষ্টি না কমা পর্যন্ত পরিস্থিতির উন্নতির সম্ভাবনা নেই।
নোয়াখালীতে ২৪ ঘণ্টায় ২২৩ মি.মি. বৃষ্টিতে সদর, কোম্পানীগঞ্জসহ কয়েকটি উপজেলায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। কুমিল্লা, বরিশাল ও লক্ষ্মীপুর শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও নিচু এলাকাগুলো পানিতে তলিয়ে গেছে। বরিশালে ড্রেন সংস্কারের কাজ বর্ষার সময় হওয়ায় জনদুর্ভোগ বেড়েছে। কুমিল্লায় দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। লক্ষ্মীপুরে পুকুর ভেসে মাছ বেরিয়ে যাওয়ায় চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত।
টাঙ্গাইলের যমুনা নদীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বাড়ছে। কিছু এলাকায় বিপৎসীমা ছুঁই ছুঁই করছে। ভারী বর্ষণে সদর, ভুয়াপুর, নাগরপুরসহ জেলার অনেক নিচু এলাকা ইতোমধ্যেই প্লাবিত হয়েছে।
আষাঢ়ের বৃষ্টিতে ঝিনাইদহ শহর ও গ্রামীণ এলাকাগুলো ডুবে গেছে। শহরের প্রধান সড়কগুলো রিকশা ও ইজিবাইক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কৃষকরা আগাম রোপণকৃত ধান ও সবজি খেত ডুবে যাওয়ায় চিন্তিত।
সারাদেশজুড়ে চলমান এ দুর্যোগে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ ও পাহাড়ি ও নদী তীরবর্তী অঞ্চলের বাসিন্দারা। দ্রুত ত্রাণ সহায়তা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, বৃষ্টিপাত আরও কয়েকদিন অব্যাহত থাকতে পারে, ফলে দুর্যোগ পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।