বাংলাদেশের লালমনিরহাটে একটি আধুনিক বিমানঘাঁটি নির্মাণে চীনের সহায়তা চাওয়ার খবর ভারতের নয়াদিল্লিতে কৌশলগত উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ব্যবহৃত লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এটি ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই সম্ভাব্য প্রকল্পটি ভারতের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ‘চিকেনস নেক’ করিডোরের অত্যন্ত সন্নিকটে হওয়ায় নয়াদিল্লি বিষয়টিকে জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখছে।
‘চিকেনস নেক’ নামক করিডোরটি পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এলাকায় অবস্থিত একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড, যার মাধ্যমে ভারতের মূল ভূখণ্ড উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত। এই অঞ্চলটি ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও চীনের মধ্যে সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এটি ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর।
চীনের লালমনিরহাটে বিমানঘাঁটি নির্মাণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ভারতের সামরিক ভারসাম্যে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশ্লেষকদের মত। কারণ, এই অঞ্চলে একটি বিমানঘাঁটি থেকে চীন খুব সহজেই ভারতের অভ্যন্তরে নজরদারি কিংবা সামরিক তৎপরতা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে।
এই প্রকল্পকে বাংলাদেশ তার পরিত্যক্ত সম্পদ আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে দেখাতে পারে। তবে এর ভৌগলিক অবস্থান ভারতের জন্য স্পর্শকাতর। সিলিগুড়ি করিডোরের কাছাকাছি হওয়ায় এবং এতে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি এয়ার ফোর্স (PLAAF)-এর সম্ভাব্য সম্পৃক্ততা থাকায় ভারত তার অঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়ে ভাবছে।
লালমনিরহাট এয়ার বেস
লালমনিরহাট বিমানঘাঁটি ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশরা প্রতিষ্ঠা করে এবং এটি ১,১৬৬ একর এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এটি নেপাল, ভুটান এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় একটি কৌশলগত ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষে এটি প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (BAF) বর্তমানে এখানে একটি ছোটখাটো ইউনিট, একটি সামরিক খামার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাস পরিচালনা করে।
সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন এই বিমানঘাঁটি পুনরুজ্জীবিত করে একটি আধুনিক সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করতে চায়। এজন্য চীনের সহায়তা চাচ্ছে। যদিও ঢাকা বা বেইজিং এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি, তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান মোহাম্মদ ইউনুসের সাম্প্রতিক চীন সফরের সময় বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো সহযোগিতা বাড়ানোর লক্ষ্যে কাজ করছে, তবুও নিরাপত্তা-সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন কূটনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করতে পারে।
এই ঘাঁটির অবস্থান ভারতের সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে এবং সিলিগুড়ি করিডোর থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে। এটি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সঙ্গে সংযোগকারী একটি সংকীর্ণ ভূখণ্ড। সেখানে চীনের যেকোনো সামরিক উপস্থিতি ভারতের জন্য একটি কৌশলগত ঝুঁকি হতে পারে। যদি PLAAF এই ঘাঁটি ব্যবহার করে, তাহলে তা ভারতের উপর নজরদারি চালানো এবং যেকোনো সংঘাতে দ্রুত হামলা পরিচালনার সুযোগ দিতে পারে। ভারতের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র দপ্তর বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে চিকেনস নেক এলাকায় শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রাখলেও, চীনা প্রভাব এত কাছাকাছি পৌঁছালে সেটিকে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ভারতের আধুনিক কামান, যেমন ১৫৫ মিমি বোফোর্স ও স্বদেশীয় ATAGS, ৩০–৪০ কিলোমিটার দূরে থাকা লক্ষ্যবস্তুতে নিখুঁতভাবে আঘাত হানতে সক্ষম। ফলে যুদ্ধে এই ঘাঁটিকে সহজেই অকেজো করা সম্ভব।
এদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাকিস্তানের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের ঢাকা সফর। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার আগামী ২৪ এপ্রিল ঢাকা সফর করবেন এবং তার আগে, ১৭ এপ্রিল পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালোচ বাংলাদেশে আসছেন। এই সফরে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরের সম্ভাবনা রয়েছে। ২০১২ সালের পর এই প্রথম পাকিস্তান থেকে মন্ত্রী পর্যায়ের প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফর করছেন।
বাংলাদেশ তার ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ এর আওতায় সামরিক অবকাঠামো উন্নয়নের অংশ হিসেবেই এই প্রকল্প করছে। তবে চীনের সম্পৃক্ততা ও ঘাঁটি লিজ দেওয়ার সম্ভাবনার বিষয়টি এটিকে কৌশলগত মাত্রায় নিয়ে গেছে। মোহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকারের চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ভারতের কূটনৈতিক অঙ্গনে শঙ্কা তৈরি করছে। চীন ও বাংলাদেশের সম্ভাব্য যৌথ প্রকল্পটি শুধুমাত্র দুই দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতিফলন। এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব ক্রমশ বেড়ে চলায় ভারত তার নিরাপত্তা এবং কৌশলগত অবস্থান নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে।চীনের সহায়তায় এই ঘাঁটি নির্মিত হলে তা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্যকেই প্রভাবিত করবে না, বরং ভারত–বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কেও উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।