আফগানিস্তান—যে নাম শুনলেই অনেকের মনে ভেসে ওঠে যুদ্ধ, ধ্বংস আর অনিশ্চয়তার দৃশ্য। কিন্তু আজকের আফগানিস্তান সে পরিচয় পেছনে ফেলে নতুন এক বাস্তবতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ, দখলদারিত্ব আর ধ্বংসযজ্ঞের কাল পেরিয়ে আফগানিস্তান বা ইমারতে ইসলাম আজ যেন এক নতুন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত।
যুদ্ধবিগ্রহ থেমে গেছে, বোমা-বারুদের গর্জন নিস্তব্ধ, দুর্নীতি প্রায় শূন্যের কোটায়। দেশের সব বিদেশি ঋণ পরিশোধ করে এখন অর্থনীতি আত্মনির্ভরতার পথে। ৩০ লক্ষ মাদকাসক্তকে পুনর্বাসনের মাধ্যমে সমাজে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, বন্ধ হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি। মানুষ এখন কাজের সন্ধানে সক্রিয়।
রাষ্ট্রীয় সহায়তায় দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, এতিম ও বিধবারা পাচ্ছেন নিয়মিত সহযোগিতা। আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ইরান ও পাকিস্তান থেকে আসা প্রায় ৩০ লক্ষ শরণার্থীকে—জমি ও আর্থিক সহায়তাসহ। দেশটির বৃহত্তম কাশ তেপা খাল প্রকল্প (দৈর্ঘ্য: ২৮৫ কিমি) মরুভূমিকে বদলে দিচ্ছে উর্বর কৃষিজমিতে। একইসঙ্গে সৌর ও বায়ুশক্তি কেন্দ্রের বিস্তার দেশের বিদ্যুৎ সংকট লাঘব করে এনেছে টেকসই উন্নয়নের আশা।
আইএসআইএস সন্ত্রাসীদের নির্মূল এবং ৫ লক্ষ পূর্ববর্তীস সরকারি কর্মীকে ধরে রাখার ফলে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হয়েছে। শারিয়াহভিত্তিক সুদমুক্ত ব্যাংকিং চালু হয়েছে, বিদেশি মুদ্রার ব্যবহার সীমিত করে আফগানির মান স্থির রাখা হয়েছে। এর ফলে দেশীয় অর্থনীতিতে এসেছে স্বচ্ছতা ও আত্মনির্ভরতার চেতনা।
যুদ্ধবাজ ও দুর্নীতিবাজরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। সরকারি বাজেট থেকেই বেতন পরিশোধ হচ্ছে, বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরতা নেই। আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল ও রেলপথ চালু হওয়ায় বাণিজ্যিক গতিশীলতা বেড়েছে।
সামাজিক সংস্কারেও এসেছে পরিবর্তন। পাপ ও সদাচার বিভাগ এখন কেবল পরামর্শদাতা; গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অধিকার তাদের নেই। জোরপূর্বক বিয়ে, উচ্চমূল্যের বিবাহপ্রথা নিষিদ্ধ। টিভি, ক্যামেরা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আর কোনো বিধিনিষেধ নেই।
তবে নারীদের শিক্ষায় এখনো রয়েছে সীমাবদ্ধতা। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় প্রবেশে বিধিনিষেধ থাকলেও আশার কথা হলো—আফগান প্রশাসন শারিয়াহ মোতাবেক নারীদের জন্য পৃথক ক্লাস, নারী শিক্ষক ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করে শিক্ষার দ্বার খুলে দিতে চাচ্ছে। তালেবান সরকারের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী শের আব্বাস স্তানিকজাই এর মতে, “শারিয়াহ অনুযায়ী নারী শিক্ষায় কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।”
এছাড়া, Begum TV-এর মতো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও জাতিসংঘের সহযোগিতায় অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে হাজারো নারী শিক্ষা অর্জন করছেন। প্রযুক্তির সাহায্যে নারী উদ্যোক্তা, স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষাবিদেরা সমাজে নতুন জায়গা করে নিচ্ছেন।
যয়নাব ফিরোজীর মতো সাহসী উদ্যোক্তা নারীরা আফগানিস্তানের নারীদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছেন—তাদের উদ্যোগ শুধু অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার পথ খুলে দিচ্ছে না, বরং নারী অধিকারের নতুন মানদণ্ডও গড়ে দিচ্ছে।
এই সব অর্জনের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থা। আফগানিস্তানের তালেবান নেতৃত্বাধীন ইমারতে ইসলামিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক (দ্য আফগানিস্তান ব্যাংক)-এর উপ-গভর্নর সেদিকুল্লাহ খালিদ একটি ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ঘোষণা করেছেন যে, দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকিং খাতে সূদভিত্তিক লেনদেন সম্পূর্ণরূপে বাদ দিয়েছে এবং এখন একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আগে বখতিয়ার ব্যাংক হিসেবে পরিচিত বর্তমান ইসলামিক ব্যাংক অফ আফগানিস্তান -এর মাধ্যমে মুদারাবা, মুশারাকা ও ইজারা ভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে, যা সুদবিহীন অর্থনীতিকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে।
আজকের আফগানিস্তান শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, অর্থনীতি—সব দিক থেকেই পুনর্গঠনের পথে। যুদ্ধোত্তর বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আফগানরা এখন শুধু শোক নয়, বরং স্বপ্ন নিয়ে পথ হাঁটছে।
আফগানিস্তানের বর্তমান বাস্তবতা এক দিক থেকে পৃথিবীকে বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তার সন্ধান দিচ্ছে—যেখানে পশ্চিমা শাসনমডেলের পরিবর্তে ইসলাম ধর্মভিত্তিক ইনসাফ ও সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকেই ন্যায়ের মাপকাঠি হিসেবে ধরা হচ্ছে। ইসলামি রাষ্ট্র মডেল নিয়ে যারা সবসময় প্রশ্ন তোলে, তাদের জন্য আফগানিস্তান একটি জীবন্ত পরীক্ষাগার—যেখানে শারিয়াহভিত্তিক সুদমুক্ত ব্যাংকিং বাস্তবায়িত হচ্ছে, আইএসআইএস নির্মূল হয়েছে, জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা সক্রিয় এবং সামাজিক সংস্কারে শৃঙ্খলা ফিরছে।
আফগান জাতি যদি এই নবজাগরণকে কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সংহত করে এগিয়ে নিতে পারে, তবে তারাই হবে মুসলিম বিশ্বের অনুপ্রেরণা।
বিশ্ব এখন বিকল্প খুঁজছে—যেখানে রাষ্ট্র গঠনের ভিত্তি হবে জবাবদিহিতা, সুশাসন ও ইনসাফ। আফগানিস্তান যদি সত্যিই শারিয়াহ ও মানবিকতা একত্রে মিলিয়ে একটি কার্যকর মডেল তৈরি করতে পারে—তবে সেটিই হতে পারে ২১ শতকের নতুন রাষ্ট্রদর্শনের এক সফল দৃষ্টান্ত।
তথ্যসূত্র: