সম্পাদকীয় - দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ
নোটিশ:

সম্পাদকীয়

সম্পাদকীয়
  • আপডেট সময় বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫
  • ১৭ বার দেখা হয়েছে

মধ্যপ্রাচ্যের ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের ১২‑দিনের রক্তাক্ত সংঘাত শেষে ২৪ জুন ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি এসেছে। ইসরায়েল তেহরানে হামলার পর ইরান সরাসরি তেল আবিবে বড় ধরনের হামলা চালায়, আর ইসরায়েলও পাল্টা আঘাত হানে। শেষ দিকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে। ইরান এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আরও প্রতিশোধের হুমকি দেয় এবং কাতারে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হলেও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি।

এই যুদ্ধ ইরানের জন্য অনেক বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে। শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ইরানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ শহীদ হয়েছেন এবং ইরানের বিভিন্ন স্থাপনা ও পারমাণবিক প্রকল্প যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যদিও ইরান বলছে, তারা দ্রুত সেটা মেরামত করবে। তবে খোদ আমেরিকার গোয়েন্দা বিভাগ  বলছেন, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পে তেমন ক্ষতি হয়নি, পারমাণবিক কর্মসূচি কয়েক মাস পিছিয়ে গেছে মাত্র। ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন হামলায় ইসরায়েলে অন্তত ২৮–৩০ জন নিহত এবং ৩২০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। তেল আবীব, রেহোভোট, বিইর শেবা, হাইফাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহরে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। রেহোভোটের বিশ্ববিখ্যাত ‘ওইজম্যান ইন্সটিটিউট’-এর ল্যাবেও আঘাত লাগে, যার ফলে শত শত গবেষণা ও পরীক্ষার সামগ্রী নষ্ট হয়।

এই যুদ্ধে ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা লেগেছে তাদের আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়। এতদিন ধরে এই আয়রন ডোমকে বিশ্বের সেরা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলা হতো। কিন্তু ইরান একসাথে ড্রোন, ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল ছুঁড়ে সেই ডোমকে চাপে ফেলে দেয়। অনেক জায়গায় আয়রন ডোম ব্যর্থ হয়, বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ভেদ করেই শহরের ভেতরে পড়েছে। বিশেষ করে তেল আবীব, রেহোভোট ও বেইর শেবায় ক্ষেপণাস্ত্র আঘাতে বড় ধ্বংসযজ্ঞ হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরান একসাথে এত বেশি ও নানা ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছিল যে, আয়রন ডোম তার সক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ফলে প্রতিরক্ষা ব্যয়ও আকাশছোঁয়া হয়ে যায়। প্রতিটি ইন্টারসেপ্ট করতে ৪ মিলিয়ন ডলার করে খরচ পড়েছে, তবু সব আটকানো যায়নি। এতে প্রমাণ হয়েছে — আয়রন ডোম অনেক শক্তিশালী হলেও একসাথে বড় আকারের ও জটিল আক্রমণের মুখে সেটাও দুর্বল হয়ে পড়ে।

এই যুদ্ধের সময় গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের দমনপীড়ন অব্যাহত ছিল। ফলে গাজায় মানবিক বিপর্যয় ভয়াবহ আকার নেয়। হাসপাতাল ভেঙে পড়েছে, বিদ্যুৎ নেই, খাবার নেই, বিশুদ্ধ পানির সংকট। হাজার হাজার মানুষ শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। শিশুরা অনাহারে ও রোগে মরছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গাজার এই পরিস্থিতি এখন ইতিহাসের অন্যতম বড় মানবিক বিপর্যয়।

এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে মুসলিম বিশ্ব আবারও নিজেদের দুর্বলতা প্রমাণ করেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ অনেক মুসলিম দেশ শুধু মুখে নিন্দা করেছে। কেউ কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পাকিস্তান, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া প্রতিবাদ জানিয়েছে, কিন্তু আসল লড়াইয়ের মাঠে তারা ছিল না। তবে কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে বিমান হামলার পর মধ্যস্ততার ব্যাপারে কিছুটা সক্রিয় দেখা গিয়েছে।

অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া যুদ্ধ থামানোর জন্য কূটনৈতিকভাবে তৎপর ছিল। তারা যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায় এবং জাতিসংঘেও ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলে। তবে তারাও সরাসরি কোনো সাহায্য পাঠায়নি। চীন নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় এবং রাশিয়া ইরানের পুরোনো মিত্র হওয়ায় শান্তি আলোচনার পক্ষে থেকেছে।

এই পুরো পরিস্থিতির প্রভাব বাংলাদেশে  প্রত্যক্ষভাবে না পড়লেও পরোক্ষভাবে তো রয়েছেই। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে লাখ লাখ বাংলাদেশি কাজ করছেন। এই অঞ্চলে যুদ্ধ হলে তাদের জীবনে ঝুঁকি বাড়ে, রেমিট্যান্স কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ইরানে অবস্থানরত বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে আনার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করে বাংলাদেশ। ওদিকে আবার তেলের আন্তর্জাতিক বাজারও অস্থির হয়ে উঠেছিল। যদিও  বাংলাদেশ সরকার তেলের দাম বাড়ায়নি, তবে নজরদারিতে রেখেছিল। এই অবস্থায় বাংলাদেশের উচিত — বিকল্প তেলের উৎস ঠিক করা। দেশের বাজারে কেউ যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সেই জন্যও সরকারের নজরদারি বাড়ানো দরকার। পাশাপাশি ইরান ও গাজার এই মানবিক বিপর্যয়ে বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে এগিয়ে আসতে পারে। খাদ্য, পানি, ওষুধ পাঠিয়ে সহানুভূতির বার্তা দিতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলেও গাজার পক্ষে এবং ইসারইলী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আরও জোরালো অবস্থান নেওয়া দরকার।

সবশেষে বলতে হয়, যুদ্ধ শেষ হলেও শান্তি আসেনি। ইসরায়েলের প্রতি মানুষের ক্ষোভ এখনো তীব্র। গাজায় মানুষের কান্না থামেনি। মুসলিম বিশ্ব আবারও নিজেদের দুর্বল প্রমাণ করেছে। এই সময় বাংলাদেশের উচিত সাহসিকতা, মানবিকতা আর দূরদর্শিতার সঙ্গে পথ চলা।

শেয়ার করুন

Comments are closed.

এই ধরনের আরও নিউজ

© কপিরাইট ২০২৪-২০২৫ | সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত

ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: NagorikIT