
১৩ মার্চ প্রকাশিত টাইম ম্যাগাজিনের ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস অব ২০২৫’–এ বিশ্বের ১০০টি স্থাপনাকে ‘দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট প্লেসেস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে টাইম ম্যাগাজিন। সে তালিকায় প্রথমবারের মতো স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের স্থাপনা। এ তালিকায় স্থান করে নেয়ে সাভারের আশুলিয়ার জামগড়ার দরগার পাড় এলাকার জেবুন নেসা মসজিদ। টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তালিকার প্রতিবেদনে মসজিদটি সম্পর্কে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্থপতিরা দীর্ঘদিন ধরে অত্যাধুনিক মসজিদ ডিজাইন করে আসছেন; কিন্তু ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থিত এই গোলাপি রঙের স্থাপনাটি তার শিল্প পরিবেশের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় চিত্র তুলে ধরে।

আইডিএস গ্রুপের তৈরি পোশাক কারখানার প্রায় সাড়ে ছয় হাজার গার্মেন্টস কর্মীর জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছে। মসজিদটি এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যাতে পুরুষ ও নারীরা সহজেই প্রবেশ করতে পারে ও নামাজ আদায় করতে পারে। মসজিদটিতে পুরনো ঐতিহ্য আর আধুনিক নকশার সুন্দর মেলবন্ধন দেখা যায়। এর গোলাপী রং দেশের ঐতিহ্যবাহী টেরাকোটা ও মাটির স্থাপত্যের ছোঁয়া বহন করে। এর ছোটো ছোটো ছিদ্র বাংলাদেশের জাফরিকাটা নকশার কথা মনে করিয়ে দেয়। এতে পর্যাপ্ত বাতাস ও আলোও প্রবেশ করতে পারবে। এর কেন্দ্রীয় গম্বুজই পুরো মসজিদটিকে ধরে রাখে এবং প্রাকৃতিকভাবে ঠাণ্ডা রাখে – কোনো এয়ার কন্ডিশনিংয়ের প্রয়োজন হয় না। বিখ্যাত এই মসজিদে এসি তো দূরের কথা, একটা ফ্যানও নেই। মসজিদের সামনে রয়েছে কাঁচে ঘেরা একটি সরু লেক। এই লেকের পানির মাধ্যমে বাতাস প্রাকৃতিকভাবে শীতল হয়ে প্রবেশ করে মসজিদে। এই কারণেই মসজিদটিতে লাগানোর প্রয়োজন হয়নি এসি কিংবা বৈদ্যুতিক পাখার। চতুর্ভুজাকৃতির মসজিদটিতে নেই কোনো চিরাচরিত স্তম্ভ। মাঝখানের গোল গম্বুজটিই মসজিদের মূল ভিত। প্রাকৃতিকভাবে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য মসজিদের কংক্রিটের দেয়ালে ছোট ছোট আয়তাকার শূন্যস্থান বা ফুটো রেখেছেন স্থপতি। বাংলাদেশের স্থাপনা এর চারপাশের চারটি কোনকে বলা যায় ‘লাইট কোর্ট’। অনেকটা বাংলাদেশের সংসদ ভবনের প্রেয়ার হলের মতো। সেদিক দিয়েও আছে আলো-বাতাসের অবাধ যাতায়াত। বাগানের গাছগুলোতে রিসাইকেল করা পানি দেওয়া হয়। এতে পরিবেশ ও প্রতিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধেরই প্রমাণ মেলে। দেশের গ্রামীণ ঐতিহ্য, পারস্য বাগানের নকশা ও বিখ্যাত স্থাপত্যের অনুপ্রেরণায় এই মসজিদ TIME Magazine-এর World’s Greatest Places 2025 তালিকায় এক বিশেষ স্থান অর্জন করেছে। মসজিদটির নকশাতে শুধু নির্মাণগত নান্দনিকতাই ফুটে উঠে না, কর্মীদের জন্য এক ধরনের প্রশান্তি ও প্রতিফলনের জায়গাও তৈরি হয়।

মসজিদটির স্থপতি সায়কা ইকবাল মেঘনা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। তিনি স্টুডিও মরফোজেনেসিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক। আইডিএস গ্রুপের এমডি তার প্রয়াত মা জেবুন নেসার নামে বানিয়েছেন এই মসজিদ।
স্থপতি মেঘনার ভাষ্যমতে, এই ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পাউন্ডের মালিক চেয়েছিলেন তার কর্মীদের জন্য একটি মসজিদ তৈরি করতে এবং একইসঙ্গে তার মায়ের স্মরণে এমন কিছু নির্মাণ করতে, যাতে ইট-পাথরের কাঠামোর ভেতরেও থাকবে শিল্পের নরম-পেলব স্পর্শ। আর সেজন্যই এই মসজিদটি একইসঙ্গে হয়ে উঠেছে একটি আধ্যাত্মিক ও সামাজিক স্থান, যেখানে পারস্পরিক যত্ন ও বিশ্বাসের মাধ্যমে মালিক ও কর্মীদের মধ্যে নির্মিত হবে এক উষ্ণ সম্পর্ক। মেঘনা বলেন, ‘আমার কাজের উদ্দেশ্য মূলত এই ব-দ্বীপের শহরগুলোর আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা, পরিত্যক্ত স্থানগুলোকে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই করে গড়ে তোলার মাধ্যমে স্থানগুলোর সুপ্ত স্বভাব জাগিয়ে তোলা।’

মুসল্লিরা বলছেন, শুধু এই এলাকাতেই নয়, সারাদেশের মধ্যে এরকম নকশার মসজিদ একটাই। গার্মেন্টস কর্তৃপক্ষ শ্রমিকসহ সবার নামাজের জন্য এত সুন্দর একটি মসজিদ নির্মাণ করায় তারা কৃতজ্ঞ। অনেক গরমের মধ্যেও ফ্যান ছাড়াই এই মসজিদে শীতল পরিবেশে নামাজ আদায় করেন তারা। পবিত্রতার প্রতীক ফিরোজা কালারের টাইলস দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন অজুখানা। এছাড়া সুন্দর ব্যবস্থাপনায় এই মসজিদের মনোরম পরিবেশে নামাজ পড়তে পেরে খুশি গার্মেন্টস শ্রমিক নারী মুসল্লিরাও।

নারীদের নামাজ আদায়ের জন্য আছে আলাদা স্থান
মসজিদটির ইমাম হাফেজ মুফতি মো. শফিকুল ইসলাম জানান, সারাদিন গার্মেন্টসের ভেতরে কাজ শেষে বিরতির সময় মসজিদের মনোরম পরিবেশে নামাজ আদায় করলে শ্রমিকদের মন প্রফুল্ল থাকে। মালিকপক্ষ শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে এত সুন্দর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন যা দৃষ্টান্ত।
এই মসজিদ শুধু একটি প্রার্থনার স্থান নয়, এটি বাংলাদেশের স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

জেবুন নেসা মসজিদ নামাযরত মুসল্লি
- দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর সর্বশেষ নিউজ পড়তে ক্লিক করুন: সর্বশেষ
- দৈনিক সাবাস বাংলাদেশ এর ফেসবুক পেজটি ফলো করুন: dailysabasbd