পাকিস্তানের ক্রিকেট যেন সময়ে আটকে গেছে—একটি গৌরবময় অতীত, একটি বিশৃঙ্খল বর্তমান এবং একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
“তোমার রুম নম্বর কত?” পাকিস্তানের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান জাভেদ মিয়াঁদাদ বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন ভারতের বোলার দিলীপ দোশিকে। কারণ? মিয়াঁদাদ চেয়েছিলেন বলটি এত জোরে মারতে যাতে সেটি ছয় হয়ে সরাসরি দোশির হোটেল রুমে গিয়ে পড়ে।
ভীড়ে ঠাসা ইডেন গার্ডেন্স, উত্তেজনা চরমে। পাকিস্তানের গতিতারকা শোয়েব আখতার সদ্য বোল্ড করেছেন ভারতের ব্যাটিং কিংবদন্তি রাহুল দ্রাবিড়কে। এরপর মাঠে আসলেন আরেক মহারথী—শচীন টেন্ডুলকার।
প্রথম বল—আখতার দৌড়ালেন, বল ফুল লেংথ, সুইং করে ঢুকে গেল। শচীন বুঝতে পারলেন না, বলটি স্টাম্প ভেঙে দিল! কয়েক সেকেন্ডের জন্য ইডেন গার্ডেন্স নিস্তব্ধ। এমনকি আখতারও যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারপরই চারদিক থেকে গর্জন উঠল!
এটা ছিল মিয়াঁদাদ এবং আখতারের খেলার ধরন, মাঠে প্রতিপক্ষকে দখলে নেওয়ার কৌশল। কিন্তু শুধু ওরাই নয়, এটাই ছিল পাকিস্তানের ক্রিকেটের নিজস্ব ঘরানা।
আমার সম্পাদক যখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “পাকিস্তানের ক্রিকেট নিয়ে কী ঘটছে?”—আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, এর জন্য একটা শোকবার্তা সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। শোকবার্তা একটু সাদামাটা লাগতে পারে, কারণ দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রিকেট শুধুমাত্র একটি খেলা নয়—এটি আবেগ, এটি ধর্মের মতো। তাই, আরও উপযুক্ত শব্দ হতে পারে “মার্সিয়া”—উর্দু ভাষায় একটি শোকগাথা, যা মৃতদের জন্য শোকপ্রকাশ করতে লেখা হয়, অনেক সময় এতে ধর্মীয় আবহও থাকে।
হয়তো ক্রিকেটই একমাত্র বিষয় যা পাকিস্তানিদের তাদের ধর্মের মতোই ঐক্যবদ্ধ করে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, হঠাৎ ক্রিকেট, শোকগাথা, এবং পাকিস্তান—সব একসাথে কেন?
কারণ, রোববার পাকিস্তান তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের কাছে বিধ্বস্ত হলো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে। এই টুর্নামেন্টটি পাকিস্তানই স্বাগতিক ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাদের “হোম” ম্যাচও নিরপেক্ষ ভেন্যুতে খেলতে হলো। সংক্ষেপে বললে: ১৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া পাকিস্তানের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি কার্যত ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই শেষ হয়ে গেল। ফলে দরকার পড়ল একটি “মার্সিয়া”র।
কঠোর পাকিস্তানি ক্রিকেট সমর্থকদের জন্য এটা ছিল এক ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন—একটা এমন দিন, যা তারা দীর্ঘদিন ধরে ভয় পেয়েছিল কিন্তু মেনে নিতে পারেনি।
মিয়াঁদাদ এবং আখতার তাদের লড়াকু মানসিকতার জন্য পরিচিত ছিলেন—যা প্রতিপক্ষরাও স্বীকার করবে। আজকের পাকিস্তানি দলের পারফরম্যান্সের সঙ্গে সেটা তুলনা করলে মনে হয় যেন “একটি ধীরগতির, চূড়ান্ত পতন”।
২০২২ সাল থেকে পাকিস্তান ক্রিকেট তার ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো, তারা বারবার নতুন নতুন অতল গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে। এমনকি দেশটির ক্রিকেট-ভিত্তিক মিম সংস্কৃতিও যেন এখন হতাশায় পরিণত হয়েছে।
২০২৩ সালের এশিয়া কাপ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও রাজনৈতিক কারণে তা হাইব্রিড মডেলে শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানের পারফরম্যান্স হতাশাজনক ছিল, শুধু কিছু বোলিং মুহূর্তেই সামান্য আলোড়ন তুলতে পেরেছিল তারা।
এরপর ভারতের মাটিতে, বিশ্বকাপের মঞ্চে, পাকিস্তান প্রথম রাউন্ডেই বিদায় নিল—এমনকি আফগানিস্তানের কাছেও প্রথমবারের মতো হেরে গেল।
(তবে বলতে হয়, আফগানিস্তানের অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণেই এই হার)।
কিন্তু দুর্ভাগ্য এখানেই শেষ হয়নি। ক্রিকেটের সবচেয়ে দ্রুতগতির সংস্করণ এবার পৌঁছেছিল আমেরিকায়—যেখানে পাকিস্তানের ২০০৯ সালের চ্যাম্পিয়নশিপের স্মৃতি ছিল। তবে এবার সুযোগের দেশ আমেরিকায় পাকিস্তানের জন্য কোনও সুযোগ ছিল না। গ্রুপ পর্বেই বিদায় নিল “গ্রীনশার্টস”—ভারতের কাছে হার এবং আমেরিকার কাছেও হারিয়ে!
স্থানীয় ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলছিলেন, আমেরিকার বিপক্ষে হারটি পাকিস্তানের জন্য জাগরণের ঘণ্টা হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা কি সত্যিই হলো? নাকি এটি শুধু আরও এক অধ্যায় হয়ে রইল—যেখানে পাকিস্তান নিয়মিতভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলের কাছে পরাজিত হচ্ছে? এরপরই এল আরেক দুঃখজনক ঘটনা—টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করল।
তাহলে কি পাকিস্তান তার জয়ী মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে? এতটা বাজে পরিস্থিতি তৈরি হলো কেন?
একটু গভীরে তাকালে বোঝা যায়, সমস্যার শিকড় ম্যানেজমেন্টে লুকিয়ে আছে। ২০২১ সালের পর থেকে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (PCB) চারবার চেয়ারম্যান পরিবর্তন করেছে। প্রত্যেকবার নতুন চেয়ারম্যান মানে নতুন সিলেকশন কমিটি, নতুন প্রশাসন, নতুন পরিকল্পনা।
ফলাফল?
নেতৃত্বের অস্থিরতা, দলীয় গঠনে বারবার পরিবর্তন, এবং মাত্র চার বছরের মধ্যে ছয়জন ভিন্ন ভিন্ন খেলোয়াড়কে অধিনায়ক বা সহ-অধিনায়ক হিসেবে বদলানো হয়েছে।
কিন্তু এত কিছুর পরেও এক জিনিস বদলায়নি—পাকিস্তান বারবার নতুন নতুন নিচে নেমে গেছে, যার ফলে তাদের কোটি কোটি সমর্থক হতাশায় নিমজ্জিত।
এমনকি মিমও এই “জওয়াল” (পতন) সামলাতে পারেনি।
তাই, এই মার্সিয়া।
লেখক: ওমর বিন আজমল (প্রযোজক, টিআরটি ওয়ার্ল্ড)