এক যুগ আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রাঙ্গণ থেকে নিখোঁজ হওয়া সুখরঞ্জন বালি অবশেষে সামনে এসে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৩২ জনের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অভিযোগ তুলেছেন। ২১ আগস্ট সকালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দাখিল করে তিনি সাংবাদিকদের এ বিষয়ে অবহিত করেন।
সুখরঞ্জন বালি জানান, তিনি জামায়াতের প্রয়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলায় অন্যতম সাক্ষী ছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালের ৫ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণ থেকে পুলিশ ও অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তাকে অপহরণ করে। এর আগে তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন তাকে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বাধ্য করতে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিলেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা-সমর্থকদের সহযোগিতায় হুমকি ও হামলার শিকার হয়েছিলেন। তিনি সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় স্থানীয় এমপি এ কে এম আউয়াল ও পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান মালেকসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের কয়েকজন তাকে পিটিয়ে হত্যার হুমকি দেয়।
বালি বলেন, ট্রাইব্যুনালে সত্য কথা বলার জন্য ঢাকায় এসে আইনজীবীদের সাথে যখন যাচ্ছিলেন, তখন পুলিশের উপস্থিতিতে তাকে গাড়ি থেকে টেনে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে জানালাবিহীন অন্ধকার ঘরে দুই মাস আটক রেখে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। বৈদ্যুতিক শক, মারধর, কোটি টাকা ও বাড়ি দেওয়ার প্রলোভন—সব কিছুর মাধ্যমে তাকে ভাঙার চেষ্টা করা হয়। তবুও তিনি সাঈদীর বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে অস্বীকৃতি জানান।
এরপর চোখ বেঁধে তাকে সীমান্তে নিয়ে গিয়ে ভারতের বিএসএফের হাতে তুলে দেওয়া হয়। বিএসএফও তাকে নির্যাতন করে দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠায়, যেখানে তিনি পাঁচ বছর অবৈধভাবে আটক ছিলেন। বালি জানান, সেই সময়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিনিধিরা তার সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ করে নির্যাতনের বিস্তারিত নথিভুক্ত করেন। পরে মাসুদ সাঈদীর উদ্যোগে এবং ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তিনি মুক্তি পান।
দেশে ফিরে এসেও তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকেন এবং গ্রামে যেতে পারেননি। তিনি জানান, ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও প্রসিকিউটররা তার নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা গোপন করে উল্টো তার আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন। অথচ ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ফুটেজ থাকলেও তা প্রকাশ করা হয়নি।
শেখ হাসিনাসহ যাদের বিরুদ্ধে সুখরঞ্জন বালি অভিযোগ তুলেছেন তাদের মধ্যে আছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, সাবেক প্রসিকিউটর রানা দাস গুপ্ত, সাবেক চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী, সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম আউয়াল, সাবেক তদন্ত কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন এবং আরও অনেকে।
বালি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, তিনি নিজ চোখে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভাই বিশেশ্বর বালীর হত্যাকাণ্ড দেখেছেন, সেখানে সাঈদী উপস্থিত ছিলেন না। মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ার কারণে তাকে গুম, অপহরণ, নির্যাতন এবং ভারতে পাঁচ বছর অবৈধ কারাবাসে রাখা হয়েছে। তার দাবি, সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলা ছিল সম্পূর্ণ সাজানো, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তাকে শেষ পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত এই অপহরণ, গুম, নির্যাতন ও অবৈধ কারাবাস আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে মানবতাবিরোধী অপরাধ। তিনি ন্যায়বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, “আমার জীবনে ঘটে যাওয়া গুম, নির্যাতন ও অবৈধ কারাবাস একটি বৃহৎ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। আমি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত এই ভয়াবহ অপরাধের বিচার চাই।”