২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন জানিয়েছে, এটি ছিল দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত এক ষড়যন্ত্রের ফল। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ একাধিক মহলের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে। ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ আলামত ধ্বংসেরও স্পষ্ট চেষ্টা করা হয়েছিল বলে জানায় কমিশন। আজ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিআরআইসিএম নতুন ভবনে আয়োজিত তৃতীয় সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়। লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন কমিশনের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমান। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের অন্যান্য সদস্যরাও।
কমিশন জানায়, এই তদন্তে এখন পর্যন্ত ১৫৮ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আরও প্রায় ৫০ জনের সাক্ষ্য নেওয়া বাকি রয়েছে। ইতোমধ্যে শহীদ পরিবারের ৬ জন সদস্য, ১৫ জন বেঁচে ফেরা অফিসার, ৮ জন রাজনীতিবিদ, ৫৫ জন সামরিক কর্মকর্তা, ২০ জন অসামরিক ব্যক্তি এবং ২৫ জন কারাবন্দি বিডিআর সদস্যের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, ৮ জন রাজনীতিবিদের মধ্যে তিনজনকে জেলে গিয়ে, তিনজন সরাসরি এবং দুইজন ইমেইলের মাধ্যমে জবানবন্দি দিয়েছেন। বেঁচে ফেরা অফিসারদের ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দিয়ে লিখিত জবানবন্দি দিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। শহীদ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দুই দফা সম্মেলনও করা হয়েছে, যেখানে তাঁরা তাদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
পিলখানার ভেতরে কী ঘটেছিল — সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনায় উঠে এসেছে, অফিসারদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয়েছিল। তাদের পরিবারের নারী ও শিশুদের ওপর চালানো হয়েছিল অকথ্য নির্যাতন। খাবার-পানি ছাড়া আটকে রেখে ভয় দেখানো হয়েছিল। বাড়িঘর ভাঙচুর, গুলিবর্ষণ, অগ্নিসংযোগের মতো ভয়াবহ অপরাধ সংঘটিত হয়। রাষ্ট্রীয় এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি লুটপাট করে ধ্বংস করা হয়। এসব বিষয়ে বেঁচে থাকা অফিসার ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষ্য থেকে পাওয়া তথ্য কমিশন গুরুত্বসহকারে পর্যালোচনা করছে। একইসঙ্গে কমিশন বিভিন্ন সংস্থা থেকে অসংখ্য ভিডিও ফুটেজ, ছবি এবং সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে। এসবের ফরেনসিক বিশ্লেষণ চলছে।
ইতোমধ্যে বিজিবি সদর দপ্তর, ডিজিএফআই এবং র্যাব সদর দপ্তর পরিদর্শন করে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র এবং আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্তের স্বার্থে ২৫টি সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় ৩১৬টি তথ্যচাওয়ার পত্র পাঠানো হয়েছে, যার মধ্যে ১০৯টির জবাব পাওয়া গেছে। সেনাবাহিনী পরিচালিত কোর্ট অব ইনকোয়ারির প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটির প্রতিবেদনসহ বিডিআর ইউনিট পরিচালিত ৫৭টি তদন্ত প্রতিবেদনও সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। কমিশন আরও জানায়, ছয়টি দেশের দূতাবাস এবং ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয় থেকেও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পিলখানা হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশের অনেক মহলের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস ও সংস্থার সঙ্গেও যোগাযোগ অব্যাহত আছে। কমিশন মনে করে, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল দীর্ঘদিনের এক গভীর ষড়যন্ত্র, যার পরিণতিতে এতগুলো তাজা প্রাণের নির্মম পরিণতি ঘটেছে। তদন্ত কাজ এখন শেষ পর্যায়ে। কমিশন আশা করছে, অবশিষ্ট সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে প্রতিবেদনটি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে এবং ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচন করা সম্ভব হবে।