জার্মানিতে জন্ম নেওয়া তুর্কি বংশোদ্ভূত ফুটবল তারকা মেসুত ওজিল দারিদ্র্যকে পেছনে ফেলে নিজের প্রতিভার জোরে বিশ্ব ফুটবলে জায়গা করে নিয়েছেন। বিলাসবহুল পরিবেশে বড় হলেও পূর্বপুরুষের দেশ তুরস্কের সংস্কৃতি ও ইসলামি আদর্শ থেকে কখনো সরে যাননি। ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বরাবরই। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, ম্যাচের আগে কোরআন থেকে কিছু অংশ পড়েন, এমনকি সতীর্থরাও জানতেন, তখন তার সঙ্গে কথা বলা বারণ। কিন্তু ফুটবলে তার অসাধারণ প্রতিভার পরও ধর্মচর্চা তার ক্যারিয়ারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক জার্মানির রাজনৈতিক মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। ২০১৮ বিশ্বকাপে জার্মান দলের সতীর্থদের কাছ থেকে তিনি বৈষম্যের শিকার হন। ম্যাচ চলাকালে তার দেওয়া পাস নেওয়া হয়নি, এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে গোলের সুযোগও কাজে লাগানো হয়নি। মুসলিম ও তুর্কি বংশোদ্ভূত হওয়ায় এই বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন তিনি। বিশ্বকাপে ব্যর্থতার দায়ও তার ওপর চাপানো হয়, যার পরিপ্রেক্ষিতে ওজিল জার্মান জাতীয় দল থেকে অবসর নেন।
এরপর থেকে শুধু ফুটবল নয়, বৈষম্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তিনি। ২০১৯ সালে চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলমানদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান তিনি। এক টুইট বার্তায় তিনি লেখেন, ‘কোরআন পোড়ানো হচ্ছে, মসজিদ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা হচ্ছে, ধর্মীয় নেতাদের হত্যা করা হচ্ছে—তারপরও বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় নীরব।’ তার এই প্রতিবাদের পর চীনা সরকার ক্ষুব্ধ হয়ে তার ম্যাচ সম্প্রচার বাতিল করে এবং তার সাবেক ক্লাব আর্সেনালের ওপর চাপ সৃষ্টি করে।
ধর্ম ও পেশাদারিত্বকে সমান্তরালে রাখার নজিরও গড়েছেন ওজিল। ২০১৪ বিশ্বকাপে রোজা রেখেই অনুশীলন ও ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। কোচ জোয়াকিম লো তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, খেলা নাকি রোজা—উজিল সোজাসাপ্টা জবাব দেন, ‘রোজা ফরজ, আমি রোজা রেখেই খেলব।’
তার ধর্মবিশ্বাসের প্রতিফলন ফুটবলেও দেখা গেছে। এক ম্যাচে গ্যালারি থেকে কেউ তার দিকে রুটি ছুড়ে মারলে, তিনি সেটি পায়ে না মাড়িয়ে হাতে নিয়ে চুমু খান, কপালে ছোঁয়ান, তারপর একপাশে সরিয়ে রাখেন—এভাবে তিনি দেখিয়ে দেন, ইসলাম খাবারকে সম্মান করতে শেখায়।
ওজিল শুধু কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, মানবতার সেবায়ও এগিয়ে ছিলেন। রমজানে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য তুরস্কের রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে অনুদান দিয়েছেন, যা বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শিশুদের পাশাপাশি তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়া ও সোমালিয়ার শিশুদের কল্যাণে ব্যয় হয়েছে। ২০১৪ বিশ্বকাপে পাওয়া সাড়ে চার লাখ ইউরোর পুরোটাই গাজার যুদ্ধবিধ্বস্ত শিশুদের সহায়তায় দান করেন। এমনকি ফিফার কর্মকর্তাদের সঙ্গে হাত মেলাতেও অস্বীকৃতি জানান, কারণ তারা ইসরাইলকে সমর্থন দিয়েছিল।
ধর্ম ও ন্যায়বিচারের প্রতি তার অবিচল বিশ্বাসই তাকে মুসলিম বিশ্বে বিশেষ সম্মানের জায়গায় নিয়ে গেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভক্তরা তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে আখ্যা দেন—‘ওজিল: দ্য প্রাইড অব মুসলিমস।’